যে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়, তার পক্ষে নাগরিকদের মিত্র হওয়া কঠিন, বিশেষ করে দুর্বল নাগরিকদের সঙ্গে তো তার সম্পর্কটা দাঁড়ায় সরাসরি শত্রুতারই। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রের গুণাগুণের পরীক্ষা অন্য কোথাও তেমন হয় না, যেমনটা হয় ব্যক্তি-নাগরিকের জীবনে। কার সুবিধা হচ্ছে, কার জন্য ঘনিয়ে আসছে বিপদ, তা দেখেই জানা যায় রাষ্ট্রের চরিত্রটা কেমন– ভালো, নাকি মন্দ। বাংলাদেশে আমরা দু-দুইবার স্বাধীন হয়েছি। ভেবেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম। রাষ্ট্র কেমনতর স্বাধীনতা এনেছে, তার পরীক্ষা নাগরিকদের জীবনে যথারীতি হয়ে গেছে। সাতচল্লিশে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সে পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশও যে খুব সুবিধা করতে পারছে– এমনটা বলা যাবে না। বিশেষভাবে বিপদ ঘটেছে গরিব মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ে যারা সংখ্যাগুরুদের থেকে ভিন্ন, তারা আছে; এই সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কম নয়। জাতিগত পরিচয়ের সংখ্যালঘুরাও রয়েছে; এরা বাঙালি নয়। এদের সংখ্যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তুলনায় কিছু কম। সংখ্যালঘুদের ভেতর যারা গরিব, তারা আবার একবার নয় দু’বার পীড়িত হয়– একবার গরিব হিসেবে, আরেকবার সংখ্যালঘু হিসেবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে নীরবে দেশত্যাগের যে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত, তা রাষ্ট্রের জন্য মোটেই গৌরবজনক নয়।
সংখ্যালঘু সমস্যার চাপেই কিন্তু সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু ছিল; তবে মুসলমানদের সংখ্যাও কম ছিল না– এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি হবে। ব্রিটিশ শাসনের যখন অবসান হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা দেখল ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রে তাদের পক্ষে স্থায়ীভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা; তখন তারা বলল, তারা স্বতন্ত্র জাতি। তাই তাদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি প্রয়োজন। অবিভক্ত ভারতের কাঠামোতে ওই সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। ব্রিটিশের প্ররোচনা এবং দুই সম্প্রদায়ের বিত্তবান অংশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা– উভয় কারণেই সমস্যা রক্তাক্ত সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছিল, যার ফলে ভারত বিভক্ত হয়ে গেল। কিন্তু তাতে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হলো না। আসলে ভাগ হলো পূর্বে বাংলা এবং পশ্চিমে পাঞ্জাব। এই দুই খণ্ডাংশের সঙ্গে পশ্চিমের সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে যুক্ত করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, তাতে অমুসলিম সংখ্যালঘুরা যেমন রয়ে গেল; তেমনি অবিভক্ত ভারতের যে অংশ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হলো, সেখানকার মুসলমানরা পরিণত হলো সংখ্যালঘুতে। দলে দলে শরণার্থীরা ওপার থেকে এপারে আসতে এবং এপার থেকে ওপারে যেতে বাধ্য হলো। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে অবসান ঘটল– তাও নয়। এক কথায় বলতে গেলে স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে বহু মানুষের প্রাণবিয়োগ ও আশ্রয়হানির ঘটনা ঘটল।
১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাষ্ট্রও তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত নয়। উপরন্তু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অনুপ্রবেশও ঘটে গেছে। বাস্তব ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদে নেই। এই সংখ্যালঘুদের মধ্যে উর্দুভাষীর সংখ্যা অল্প। যেহেতু তারা সংখ্যালঘু এবং তাদের অধিকাংশ দরিদ্রও বটে, তাই তাদের দুর্দশাটা অত্যন্ত কঠিন। এদের খবর আমরা বড় একটা রাখি না। তার কারণ আছে। ভাষাগতভাবে এরা বিচ্ছিন্ন; তদুপরি রয়েছে জাতিগত বিদ্বেষ। উর্দুভাষীরা, বিশেষ করে ‘বিহারি’ বলে যারা পরিচিত তারা পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের সঙ্গে সদাচরণ করেনি। একাত্তর সালে তাদের ভূমিকা ছিল সরাসরি শত্রুতার। কিন্তু বিহারিরা কেউ কেউ এখনও বাংলাদেশে আছে। যারা অবস্থাপন্ন, তারা চলে গেছে। রাজনৈতিকভাবে যারা এদের ব্যবহার করত, সেই নেতৃস্থানীয় বিহারিরাও এখন আর বাংলাদেশে নেই। অধিকাংশই গেছে পাকিস্তানে; কেউ কেউ ভারতে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে যারা রয়ে গেছে, তারা নিরুপায় ও অসহায়। কেউ থাকে ক্যাম্পে, কেউ অনুন্নত নির্দিষ্ট এলাকায়। অনেকের দুর্দশা বাংলাদেশের বস্তিবাসীদের মতোই। বস্তিবাসীরা তবু সহজে চলাফেরা করতে পারে; অন্বেষণ করতে পারে জীবিকার। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদের সে সুযোগ সীমিত।
‘বিহারিজ, দি ইন্ডিয়ান এমিগ্রিজ ইন বাংলাদেশ, অ্যান অবজেকটিভ অ্যানালিসিস’ নামে আহমেদ ইলিয়াস একটি বই লিখেছেন। যেখানে এই দুর্দশা ও তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পুরো বইতে একটি দীর্ঘশ্বাস আছে, যেটি পাঠককে অনায়াসে স্পর্শ করে। কিন্তু শুধু ওই দীর্ঘশ্বাসের জন্য নয়; বইটি গুরুত্বপূর্ণ এই জন্যও যে, এতে এই উপমহাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। জাতি ও জাতীয়তা, ধর্ম ও ভাষা, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রিয়াকলাপ, সংখ্যালঘুদের অবস্থান– এসবই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে বিবেচনার মধ্যে এসে গেছে। সর্বোপরি এসেছে ব্যক্তির কথা, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রে বসবাস করে, যাকে সম্প্রদায় ও জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হয় এবং যে তার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই বিভিন্ন সংকটে পতিত হয়। বইটি যা বলে, তার চেয়েও বেশি জিজ্ঞাসা তুলে ধরে। সেই জিজ্ঞাসাগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য।
আহমেদ ইলিয়াস নিজেও একজন বিহারি। দুই পুরুষ আগে তারা বিহারের মুঙ্গের জেলা থেকে কলকাতা আসেন। সেখানেই ছিলেন তিনি ১৯৫৩ পর্যন্ত। তারপর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। একাত্তরের পরে যোগ দেন একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থায়। বইটি লিখেছেন যত্ন করে। তথ্য সংগ্রহ করেছেন আগ্রহভরে। তিনি উর্দু ভাষায় কবিতা লেখেন। তাঁর কাব্যিক সংবেদনশীলতাও এ বইতে খুব সহজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেছেন যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বিষয়গুলোকে দেখতে; যদিও সেটা কষ্টসাধ্য ছিল তাঁর পক্ষে। কেননা, একে তো তিনি সংবেদনশীল; তদুপরি যা নিয়ে লিখেছেন, তার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তবুও পড়তে গিয়ে মনে হবে না– বইটি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট।
সমস্ত বই এবং বইয়ের আলোচ্য পূর্ববঙ্গনিবাসী উর্দুভাষী মানুষদের জীবনজুড়ে যে প্রশ্নটি কখনও সরবে, অধিকাংশ সময়ে নীরবে উচ্চারিত, সেটা হলো– কেন এমনটা ঘটল। ওই অত দূর থেকে জন্মভূমি সেই বিহার ছেড়ে এতগুলো মানুষ কেন শরণার্থী হয়ে এমন একটি দেশে এলো, যার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক দূরত্ব খুবই বড় এবং একবার শরণার্থী হয়ে এসে কেনইবা তারা পুনরায় শরণার্থী হয়ে পড়ল; বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন? এসব প্রশ্নের জবাব তো আমাদের জানাই আছে। সেটা হলো উপমহাদেশের রাজনীতি। ওই রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে বিত্তবানদের নেতৃত্বে। তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। নেতারা সে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন কিন্তু ওই রাজনীতি বহু মানুষকে বিপদে ফেলেছে। কারও কারও সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়