আসাদের পতন ও সিরিয়ার ভবিষ্যৎ

হুগো বাচেগা

সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। ফাইল ছবি

বাশার আল-আসাদের পতনের বিষয়টি সপ্তাহখানেক আগেও ছিল প্রায় অচিন্তনীয়। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা এক সপ্তাহ আগে দেশটির উত্তর-পশ্চিমের ইদলিবে তাদের ঘাঁটি থেকে যে চমকপ্রদ প্রচারণা শুরু করেছিল, তখনও এতটা ভাবা যায়নি। আসাদের পতন সিরিয়ার জন্য একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা। বাশার আল-আসাদ ২০০০ সালে তাঁর বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন। আসাদের বাবা ২৯ বছর সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। অনেকটা তাঁর ছেলের মতোই শাসন পরিচালনায় ছিলেন আগ্রাসী।

আসাদ জুনিয়র তথা বাশার আল-আসাদ তাঁর বাবা থেকে কঠোর নিয়ন্ত্রিত ও দমনমূলক রাজনৈতিক নীতি পৈতৃকসূত্রে পেয়েছিলেন, যেখানে বিরোধীদের কোনোভাবেই সহ্য করা হতো না। শুরুতে তাঁর কর্মকাণ্ডে মনে হয়েছিল, তিনি তাঁর পিতা থেকে হয়তো ব্যতিক্রম হবেন। অর্থাৎ অধিক খোলা মনের ও কম অত্যাচারী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর শাসনে প্রথমে আশাবাদ জেগেছিল। কিন্তু অল্প ক’দিনেই সেই প্রত্যাশার গুড়ে বালি পড়ে।

বাশার আল-আসাদকে মানুষ তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য মনে রাখবে। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ২০১১ সালে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস আচরণের মাধ্যমে দমিয়েছিলেন। বস্তুত সেখান থেকেই সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরু। ওই সময়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়।

রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের দমন করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। রাশিয়া সিরিয়াকে শক্তিশালী বিমান সহায়তা দিয়েছিল; সিরিয়া ও হিজবুল্লাহর কাছে সামরিক উপদেষ্টা পাঠায় ইরান। লেবাননও সহায়তা করে, বিশেষ করে হিজবুল্লাহ তার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা বাশারের পক্ষে নিয়োজিত করে।

বাশারের পতনের সময় এবার অবশ্য তাঁর মিত্ররা কোনো কাজে আসেনি। তাঁর মিত্ররা এখন তাদের নিজস্ব বিষয় সামলাতেই ব্যস্ত। মূলত বাশারকে তারা পরিত্যাগই করেছে বলা যায়। এই মিত্রদের সাহায্য ছাড়া বাশারের সৈন্যরা খুব বেশি কার্যকর ছিল না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর সৈন্যরা লড়াই করতে খুব বেশি আগ্রহীও ছিল না। বিশেষ করে ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের থামাতে তারা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

গত সপ্তাহে বিদ্রোহী এই গোষ্ঠী প্রায় প্রতিরোধ ছাড়াই প্রথমে সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে, তারপর হামা শহর। এর কয়েক দিন পর দামেস্ককে বিচ্ছিন্ন করে হোমসের মূল কেন্দ্র দখলে নেয়। এর প্রায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা রাজধানীতে প্রবেশ করে আসাদের ক্ষমতার আসনও দখলে নেয়। তার মানে, পুরো সিরিয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। বাশার আল-আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের অবসান এ অঞ্চলে নতুন করে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।

বাশার আল-আসাদের পতনকে ইরান সিরিয়ায় তার প্রভাবের দিক থেকে একটি বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখছে। আসাদের শাসনামলে ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যকার সংযোগের অংশ ছিল সিরিয়া। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌঁছানোর মূল মাধ্যম ছিল সিরিয়া। ইসরায়েলের সঙ্গে বছরব্যাপী যুদ্ধ করে যাচ্ছে হিজবুল্লাহ। ইরান সমর্থিত আরেকটি গোষ্ঠী হলো ইয়েমেনের হুতিরা। তাদের বারবার বিমান হামলার নিশানা বানানো হয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস। এগুলো তেহরান প্রতিরোধের অক্ষ হিসেবে পরিচিত।

বাশার আল-আসাদের পতনে নতুন যে দৃশ্যপট দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল তাতে খুশি হতে পারে। কারণ ইরানকে তারা অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে মনে করে। অনেকেই মনে করেন, তুরস্কের আশীর্বাদ ছাড়া এ আক্রমণ সম্ভব ছিল না। সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে তুরস্ক, যদিও তুরস্ক এইচটিএসকে সমর্থন করার কথা অস্বীকার করেছে। কিছু সময়ের জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান সিরিয়ার শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে কূটনৈতিক সমাধানের জন্য বাশার আল-আসাদকে চাপ দিয়েছিলেন। কারণ এই শরণার্থীদের মধ্যে অন্তত ৩০ লাখ সিরীয় তুরস্কে অবস্থান করছিল। এই শরণার্থী সংকট তুরস্কের জন্য স্থানীয়ভাবে এক স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়। কিন্তু বাশার আল-আসাদ এরদোয়ানের অনুরোধ মানতে অস্বীকার করেন।

স্বাভাবিকভাবেই বাশার আল-আসাদের পতনে অনেকে খুশি। প্রশ্ন হলো, এর পর সিরিয়ায় কী হবে? বিশেষ করে এইচটিএসের সঙ্গে আল কায়দার সংযোগের কথা আমরা জানি। অবশ্য তারা গত কয়েক বছর জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে এবং তাদের সাম্প্রতিক বার্তাগুলোয় এক ধরনের কূটনৈতিক সমঝোতার সুর স্পষ্ট। তাতে অনেকেই আশ্বস্ত নন। এখন তাদের পরিকল্পনা কী, সেটাও জানা দরকার। বাশার আল-আসাদের পতনের মাধ্যমে যে নাটকীয় পরিবর্তনের সূচনা হলো, তা কোন দিকে যায়, সেটাও দেখতে হবে। একই সঙ্গে ফের সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দেখা দেয় কিনা, সেই ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লেখক : বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা; বিবিসি অনলাইন থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

শেয়ার করুন