কর ও নীতি সুবিধা পেয়েও দেশীয় শিল্প এখনো শিশুই রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কিছুদিন ব্যবসা করার পর বলেন আমাদের কর অব্যাহতি দেন। শারীরিকভাবে বড় হয়ে গেছে তারপরও এখনো সুরক্ষা চাচ্ছে তারা। এই সুরক্ষার দিন কিন্তু চলে গেছে।
ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ-২০২৪ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সকালে আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত সেমিনারে তিনি ব্যবসায়ীদের এসব কথা বলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে এতে আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আব্দুল হক প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনবিআর সদস্য (মূসক নীতি) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী।
শিল্প বা ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ না করে সালেহউদ্দিন বলেন, আমরা ৫০ বছর যাবত বহু শিশুকে লালন করেছি কর অব্যাহতি ও নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। আর কতকাল শিশুদের লালন করবো।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব সুরক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, প্রতিযোগিতামূলক হতে পারবো না।
কর, মূসক ফাঁকি দিলে সার্বিক অর্থনীতিতে একটা প্রভাব পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দাতাসংস্থাগুলো ট্যাক্স, জিডিপি রেশিও কর অব্যাহতি নিয়ে প্রশ্ন করছে। বিদেশের বহু জায়গায় বাংলাদেশে ট্যাক্স রেভিনিউ, সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে বহু প্রশ্ন করা হয়।
কর্মকর্তাদের আরও বেশি বন্ধুসুলভ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ উপদেষ্টা বলেন, একেবারে জোর করে আদায় করবেন। যদি অসুবিধা হয় শুনবেন। কমপ্লায়েন্স করতে একটু সহযোগিতা করবেন। বিশেষভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বিষয় সরকার বিবেচনা করবে।
এই উপদেষ্টা আরও জানান, ব্যবসায়ীরা তার কাছে এনবিআরের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ নিয়ে আসে। যদিও এনবিআরের অনেক সীমাবদ্ধতা ও ম্যান্ডেট আছে বলে ব্যবসায়ীদের মনে করিয়ে দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা আমার কাছে গেলেই এনবিআর নিয়ে অভিযোগ করে। আমি যখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলাম তখনও তারা অভিযোগ করতো। আমাদের এটা করতে হবে, ওটা করছে না। এনবিআরের সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের কতগুলো ম্যান্ডেট আছে। চাইলেই সব তো দিয়ে দেওয়া যাবে না। নাথিং ইজ ফ্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। বিনা পয়সায় কোনো কিছু, পশ্চিমা দেশে বাবা-মাও সন্তান একটু বড় হলে টাকা-পয়সা দেয় না। বিনা পয়সায় কিছুই দেয় না।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে থাকলে প্রায়োরিটি খাতে খরচ কমানো হবে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও, কর ও ভ্যাট বাড়ানোর কথা বলছি, খরচ কমানোর কথা বলছি। আবার ওইদিকে বলছি প্রায়োরিটি সেক্টরে খরচ কমাবো না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াতে খরচ কম হবে না। আমরা টাকা কোথায় পাবো। ওখানে বাড়াতে হলে আমাদের রাজস্ব আদায় করতে হবে তো। এটা আমাদের বিবেচনায় আছে। মানুষের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতিও আছে।
ট্যাক্স রেভিনিউ বাড়ানোকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, নানা কারণে শুল্ক থেকে বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই। কারণ এর প্রভাব সরাসরি জনগণের ওপর পড়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর যে পরামর্শগুলো আছে সেগুলো মেনে শুল্ক বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই। আমাদেরর মূল উৎস হচ্ছে মূসক ও আয়কর।
ব্যবসায়ীরা সরকারের পক্ষে মূসক সংগ্রহ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই দায়িত্ব পালনে ব্যাপক ঘাটতি আমরা দেখতে পাই। অনেক সময় গ্রাহক ভ্যাট দিতে চান, তারা রসিদ চান কিন্তু ব্যবসায়ীরা গড়িমসি করেন। এমন অভিযোগ আছে গ্রাহক ভ্যাট দিয়েছেন কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেটা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দেননি। এই জায়গায় আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে।
মূল প্রবন্ধে মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর আমূল বদলে গেছে রাজস্ব প্রশাসনের চিত্র। রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে বড় সংস্কারে পথে হাঁটছে এনবিআর। ৫ আগস্টের পর মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ৯৪টি নিরীক্ষা শেষ করে ১৫৯ দশমিক ৬৬ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি উদঘাটন করেছে। আদায় করেছে ৬১ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। ভ্যাট অণুবিভাগ গত ৩ মাসে ৯ হাজার ৮২৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন প্রদান, ভ্যাট আইন ও বিধি সংস্কারে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট আদায়ে সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব, করদাতার সন্তুষ্টি, কর সংস্কৃতির অভাব, নিম্ন দেশজ উৎপাদনশীলতা ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অটোমেশনের পথে হাঁটছে ভ্যাট বিভাগ।
ভ্যাট প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা কমাতে প্রয়োজন সচেতনতা।
ভ্যাটের আওতা বাড়াতে ভ্যাটের পরিমাণ কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভ্যাটের হার কমিয়ে আওতা বাড়ানো যায় কি না সেটা দেখা যেতে পারে। যদি ভ্যাটের হার কমে তাহলে এর আওতা বাড়বে। তিনি সেবা খাতে ভ্যাট কমানো ও নতুন ব্যবসা যারা শুরু করেন তাদের ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ দেন।