ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গত সোমবার ঢাকায় এক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন এমন এক আবহে, যা দিল্লির জন্য খুব একটা স্বস্তির ছিল বলা যাবে না। বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে যেরকম অভ্যর্থনা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, বিক্রম মিশ্রি যে তার ছিটেফোঁটাও পাননি, তা বলার অপেক্ষাই রাখে না!
ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও গত কয়েক দিনে নানা কারণে তলানিতে ঠেকেছিল, তারও প্রতিফলন সেই বৈঠকে অবশ্যই পড়েছিল।
‘আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় গিয়ে কথাবার্তা বলে এলেন, তাদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করে এলেন– তার মানে সব আবার আগের মতো ঠিকঠাক চলছে এটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে কী কী করা দরকার, এই আলোচনার মূল ফোকাসটা কিন্তু ছিল সেখানেই’, বলছিলেন দিল্লির সাউথ ব্লকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একটা সুস্থ ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’ বা কাজের সম্পর্ক রাখার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, তা নিয়ে বৈঠকে দু’পক্ষের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা হয়েছে।
বস্তুত, ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ওই বৈঠক আদৌ হবে কিনা, অনিশ্চয়তা ছিল তা নিয়েও। বাংলাদেশ বৈঠকের সব প্রস্তুতি সেরে রাখলেও দ্বিধা ছিল ভারতের দিক থেকেই। কিন্তু ভারত প্রায় শেষ মুহূর্তে বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা নিশ্চিত করে– কারণ দিল্লি মনে করেছিল এই প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে ঢাকাকে কিছু জরুরি বার্তা দেওয়াটা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশ যেমন ভারতের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা কী, সেটা তুলে ধরেছে– তেমনই ভারতও জানিয়েছে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাদেরও কিছু ‘কন্ডিশন’ বা শর্ত আছে। ভারতের বক্তব্য ছিল— বাংলাদেশের সঙ্গে বিগত বহু বছর ধরে তারা বিভিন্ন খাতে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তা রাতারাতি বন্ধ করাটা কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতায় সেই সম্পর্কটা বজায় রাখতে হলে ভারতেরও কিছু দাবি-দাওয়া বা শর্ত আছে!
মনে রাখতে হবে, ঢাকার বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করলেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি কিন্তু সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্ন নেননি। দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হয়নি এই বার্তাটা দিতেই ভারত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রাজি হয়নি; বরং তাদের দেওয়া সব শর্ত পূরণ হলে তবেই আবার পুরোনো প্রটোকলে ফেরা সম্ভব– এটাই বোঝাতে চেয়েছে!
এখন প্রশ্ন হলো, ভারতের দেওয়া এই শর্তগুলো কী কী?
দিল্লিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হয়েছে প্রধানত তিনটি শর্তের ওপর। সেগুলো কী, এই প্রতিবেদনে সেটাই তুলে ধরা হলো।
১. ‘এনগেজমেন্ট হবে লিমিটেড’
ভারত একটা জিনিস ঢাকার কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকারের’ সঙ্গে কখনোই ‘ফুল এনগেজমেন্টে’ যাবে না। দিল্লির বক্তব্য হলো, ভারতে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের সাংবিধানিক ভিত্তি বা নির্দিষ্ট ম্যান্ডেট কী, সেটাই পরিষ্কার নয়!
আর যদি কিছু থেকেও থাকে, তাহলে ভারতের দৃষ্টিতে তাদের মূল দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা– এর বেশি কিছু নয়।
অন্যভাবে বললে, নরেন্দ্র মোদি সরকার মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের সঙ্গে এমন কোনও আলোচনায় যাবে না, যেখানে দ্বিপাক্ষিক কোনও ইস্যুতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন আসবে। ভারত ঢাকাকে জানিয়ে দিয়েছে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই নেওয়া হবে– তার আগে নয়।
আর যতদিন না এটা হচ্ছে ততদিন বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা আমলা পর্যায়ের বৈঠক হতে পারে, কিন্তু মন্ত্রীরা কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা বা চুক্তি করবেন না। তবে যেসব চুক্তি আগে থেকেই বহাল আছে সেগুলো যেমন চলছিল চলবে।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক যখন একেবারেই ভালো নয়, তখনও কিন্তু নভেম্বরের মাঝামাঝি দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সফল আলোচনা হয়েছে, নথিপত্র বিনিময় হয়েছে! কিন্তু চুক্তির নবায়ন নিয়ে যা-ই সিদ্ধান্ত হোক, সেটা কিন্তু সে দেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই নেওয়া হবে।’
সুতরাং, ভারতের দিক থেকে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, আপাতত দুই সরকারের মধ্যে এনগেজমেন্টের পরিধি ও পরিসর ‘সীমিত’ থাকবে, এই বাস্তবতা ঢাকাকে মেনে নিয়েই চলতে হবে।
২. হিন্দুদের সুরক্ষা, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সুবিচার
ভারতের দিক থেকে এই দ্বিতীয় শর্তটাই সবচেয়ে জোরালোভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে– আর তা হলো যেকোনও মূল্যে বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এই বার্তাই ঢাকাকে দিয়েছেন যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো যদি অন্তর্বর্তী সরকার বেমালুম অস্বীকার করতে থাকে, তাহলে তা দিল্লির কাছে কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
ভারতের সংবাদমাধ্যম যে এই ঘটনাগুলো বেশ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বা অতিরঞ্জিত করে পেশ করছে— তা অবশ্য তিনিও প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তার মানে এরকম কোনও ঘটনাই ঘটছে না বলে ঢাকা যে পাল্টা দাবি করছে, সেটিও দিল্লি মানতে পারছে না।
প্রসঙ্গত, বিক্রম মিশ্রির সফরের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে ঘটা অন্তত ৮৮টি নির্যাতনের ঘটনার একটি তালিকাও পেশ করা হয়েছে, যেটিকে ভারত ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবেই দেখছে।
এছাড়া বৈঠকে অবধারিতভাবে এসেছে সনাতন জাগরণ মঞ্চের নেতা তথা ইসকন সন্ন্যাসী (সাবেক) চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের প্রসঙ্গ।
ভারত জানিয়েছে, যে দেশদ্রোহের অভিযোগে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটক করা হয়েছে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে, কিন্তু তাকে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে না, জামিন অস্বীকার করা হবে, অথবা তার হয়ে কোনও আইনজীবীও দাঁড়াবেন না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। একজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে আটকের ঘটনা যে ভারতেও হিন্দুদের মধ্যে প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, ঢাকাকে জানানো হয়েছে সে কথাও।
ভারতের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ চাইলে এই ইস্যুগুলোকে যে অবিলম্বে ‘অ্যাড্রেস’ করতে হবে, এটা পররাষ্ট্র সচিব পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিক্রি বলছিলেন, ‘আমি যতদূর খবর পেয়েছি, বিক্রম (মিশ্রি) ঢাকায় গিয়ে বলে এসেছে—আমরাও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাই, অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো শেষ করতে চাই।’
‘কিন্তু এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আপনারা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় জিরো টলারেন্স দেখাতে পারবেন, নচেৎ নয়!’, জানাচ্ছেন তিনি।
৩. শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ উত্থাপন নয়
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে বিগত কয়েক মাস ধরে একটি চরম অস্বস্তির বিষয় হয়ে রয়েছে ভারতের মাটিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি এবং সেখান থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া তার নানা রাজনৈতিক বিবৃতি, ভাষণ বা শলাপরামর্শ।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বলে এসেছে, গত ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিয়ে ও তাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে ভারত আসলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলছে এবং দিল্লির উচিত হবে তার রাশ টেনে ধরা!
এখানে ভারত পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, শেখ হাসিনা ভারতের অতিথি এবং একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি ভারতে সাময়িকভাবে আসার অনুমতি চেয়েছিলেন, যা মঞ্জুর করা হয়েছে। তিনি ভারতে গৃহবন্দিও নন, কোনও রাজনৈতিক বন্দিও নন– কাজেই বাইরের জগতের সঙ্গে তার সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করারও প্রশ্ন ওঠে না।
এখন সেটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি যদি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন, তাহলে ভারতের সেখানে সত্যিই করার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার সব বক্তব্য বা কাজকর্মেও ভারতের সমর্থন আছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা থেকে ফেরার পর দিল্লিতে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে বিক্রম মিশ্রিও ভারতের এমপিদের কাছে ঠিক একই বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
এ প্রসঙ্গে ভারত আর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টও তুলে ধরেছে– তা হলো শেখ হাসিনা কিন্তু ভারতে এসেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই। তাকে ভারতে বহন করে নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের একটি মিলিটারি এয়ারক্র্যাফট, তার জন্য ভারতের কাছে অনুমতিও চাওয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর তরফে।
কাজেই শেখ হাসিনার দেশত্যাগ যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অনুমতি সাপেক্ষেই হয়েছিল এবং তারপর থেকে সে দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বেও কোনও পরিবর্তন হয়নি– এই বিষয়টিও দিল্লির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি শীর্ষস্থানীয় সূত্র জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনাকে আতিথেয়তা দেওয়াটা যে ভারতের একটা ‘কমপালশন’– এটা কোনও প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ নয়– সেই বাস্তবতাটা উপলব্ধি করতে ঢাকাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এটাও বলা হয়েছে, সুস্থ ও স্বাভাবিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বার্থে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গটি আলোচনার বাইরে রাখলেই উভয় পক্ষের জন্য তা মঙ্গলজনক হবে বলে ভারত মনে করে।
এখন ভারতের দেওয়া এই ‘শর্ত’গুলো বাংলাদেশ কতটা মানতে রাজি হবে সেটা আগামী দিনে বোঝা যাবে। ঢাকার পক্ষ থেকেও যেসব প্রত্যাশা বা দাবিদাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে ভারত কী মনোভাব নেয়, সেটা বুঝতেও কিছুটা সময় লাগবে।
কিন্তু ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের রূপরেখায় উন্নতির আভাস দেখা যাবে, নাকি তলানিতে হাবুডুবু খাবে, তা নির্ভর করবে এই পারস্পরিক শর্তগুলো উভয়পক্ষ মানতে রাজি হয় কিনা, তার ওপর!
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন