আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নিঃসন্দেহে ২০২৪-এ এই দিনটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালিত হচ্ছে। কেননা, ৫ আগস্ট পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ৭ মার্চ, ও বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। ৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের মূল সংবিধান পুনর্লিখনের কথা জোরে শোরে বলা হচ্ছে।
অনস্বীকার্য যে, জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীরা যে সাহস, বীরত্ব, আন্দোলনের অভিনব কৌশলের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সেটি বাংলাদেশের ‘পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ’-এ যুক্ত করেছে এক নতুন মাত্রা। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এ ধরনের কর্তৃত্ববাদ উন্নয়নে সাফল্য পেলেও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, ও পুলিশের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলে, নষ্ট করে দেয় সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা, ও বিদেশ নীতির ভারসাম্য। এ ধরনের বাস্তবতা ও প্রপঞ্চের সঙ্গে কোনও সচেতন ও যুক্তশীল মানুষের দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই বললেই চলে। কিন্তু ৫ আগস্ট বিজয় অর্জনকারীদের একটি প্রভাবশালী অংশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন প্রতিপক্ষ বানালেন, কেন বাংলাদেশের মূল সংবিধানকে ছুড়ে ফেলতে চাইলেন, কেন ৫২ থেকে সোজা ২৪-এ চলে এলেন? – এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোটি জনতা বড় রকমের হোঁচট খেয়েছেন।
আমার কাছে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হচ্ছে বাঙালির গতিশীল ও আগ্রগামী ইতিহাসের এক ক্রম ধারাবাহিকতা।
১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০, ৯১, ২০১৩ হয়ে ২০২৪। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ)যে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও সামাজিক ন্যায় বিচারে’র কথা বলা হয়েছিল, তারই এক খণ্ডিতাংশ ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছা্ত্র আন্দোলন’। সেই আন্দোলনের ধার, জন-আবেদন ও প্রবল সাহসের কারণে পতন ঘটল এক প্রবল কর্তৃত্ববাদী শাসনের। এই আন্দোলন তো নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন, যার প্রধান লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার। কিন্তু বিজয় অর্জন করার পর মূল লক্ষ্য বাদ দিয়ে কেউ কেউ যখন জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন, ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, কৌশলে মুক্তিযুদ্ধকে খারিজ করার কথা বলা শুরু করলেন, তখন মানুষ বুঝতে পারলেন যে – এগুলো হচ্ছে অনেকের ‘হিডেন এজেন্ডা’, বা মূল এজেন্ডা। এটি বাস্তবায়ন করার জন্য তারা নানা মুখোশ পরেছিলেন।
বুদ্ধিজীবী দিবসের লেখা পড়তে বসে এত বড় ভূমিকা দেখে যে কেউ বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু ২০২৪-এর বুদ্ধিজীবী দিবসের লেখার প্রথমে এই ভূমিকা না দিলে এ বছর কোন প্রেক্ষাপটে এটি পালিত হচ্ছে সেটি সঠিকভাবে উপলদ্ধি করা যাবে না। ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর আল-বদর বাহিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সহধর্মিনী বাসন্তী গুহঠাকুরতা তার একটি গ্রন্থে লিখেছেন, “নীল নকশার রেখা অংকন শুরু হয়েছিল একাত্তরের পয়লা মার্চের আগেই সত্তরের ১৭ ডিসেম্বর গণভোট বা তারো অনেক আগে ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় থেকেই, কিংবা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরে। একাত্তরে তারা প্ল্যান করে যুদ্ধে নামে। যুদ্ধতো নয়, কেবল নিরস্ত্র মানুষ নিধন। প্রথমে ওদের এলোপাতাড়ি মারা, তারপর শহরে, গ্রামেগঞ্জে বেছে বেছে ধনী, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী নিধণ করে নদীতে খালে ফেলে দেওয়া…”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো নয় মাস ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী। অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা হয়নি, ফলে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে প্রামাণিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা মনে করেন।
বাংলাপিডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায় – ১৪৯ জন। তবে ইতিহাসবিদদের ভাষ্য হচ্ছে, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন কিন্তু তাদেরকে সেভাবে স্মরণ করা হয় না।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়টি ছিল পুরো পরিকল্পিত আর এটা শুরু হয়েছিল সেই ২৫ মার্চ থেকেই। কারণ আমরা দেখি, প্রথম আক্রমণ কিন্তু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর কারণ ছিল। সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে কিন্তু প্রথম দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-শিক্ষকরা। সুতরাং সেই আইয়ুব খানের আমল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সামরিক শাসকদের একটা ক্ষোভ ছিল। পরবর্তীতে সেটার আরও বিস্তার হয়েছে। ‘দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দিলে বাংলাদেশ কোন দিন স্বাধীন হলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না’ – এই চিন্তা থেকেই তারা বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে শুরু করেছিল।”
অধ্যাপক মামুন বলেন, ’সেই ৪৭ সাল থেকে রাজনীতিবিদরা মানুষকে একত্রিত করেছেন, কিন্তু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, প্রণোদনা দেয়া- সেটা কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা করেছেন। ছাত্রদের বিবেচনায় নিলে ভাষা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন থেকে সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবীরা বড় একটি ভূমিকা পালন করেছেন। সেজন্য পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের বাংলাদেশী সহযোগীদের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।” আর মি. মুঈনুদ্দীন ছিলেন ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অপারেশন ইন-চার্জ এবং মি. আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর।
ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিচার হয়েছে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর হয়েছে। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যে সকল জামায়াত নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, এবং যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, তারা হচ্ছেন আবদুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ও আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী।
এছাড়া মঈনুদ্দিন ও আশরাফকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তারা বিদেশে পলাতক থাকায় তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা যায়নি। ৪০ বছর প্রতীক্ষার পরে ৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার একদিকে যেমন ইতিহাসের দায় থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়েছে, তেমনি মানুষের ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে। কিন্তু দল হিসেবে জামায়াত-ই-ইসলামীর কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিষয়টি বিভিন্ন সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দোদুল্যমানতায় এখনও বাংলাদেশের রাজনীতির এক মীমাংসাহীন প্রহেলিকা হয়ে আছে।
এটা ইতিহাসের প্রমাণিত সত্যি যে, জামায়াত-ই-ইসলামী ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল, এবং তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনির সহযোগী হিসেবে জেনোসাইড ও অন্যান্য আর্ন্তজাতিক অপরাধ করেছিলেন। সেজন্য বাংলাদেশের আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের প্রধান সকল নেতার বিচারও হয়েছে। কিন্তু এ বিচারের আগে পরে জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, এবং ৫ আগস্টের পরে তারা ক্ষমতার অন্যতম প্রধান ভর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এতে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপিও বড় ধরনের অস্বস্তিতে পড়েছে। কখনো কখনো বিএনপি-জামায়াত বিরোধ হয়ে উঠছে গণমাধ্যমের প্রধান আলোচনার বিষয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও জামায়াতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। শুধুমাত্র পতনের দিন কয়েক আগে নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এদিকে জামায়াত-ই-ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সংবিধান পুনর্লিখন, ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা বলছেন। দলটির নতুন আমিরের কথাবার্তায় রক্ষণশীলতা থেকে সরে আসা ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে উদারতার প্রকাশ ঘটলেও তারা এখনও ৭১ সালের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন কিনা, এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে আধুনিক গণতান্ত্রিক দর্শনকে কতটা মেনে নিতে রাজি আছেন, সেটি স্পষ্ট নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে ‘ইনসাফে’র কথা শুনতে বাংলাদেশের মানুষ কতটা প্রস্তুত? কেননা, ব্যক্তি হোক আর দল হোক, অন্যায় করলে তার মাশুল দিতেই হবে। বাংলাদেশের প্রধান সকল রাজনৈতিক দলকে তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, ও সকল অপকর্মের খতিয়ান পাই পাই করে বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। আর বাংলাদেশের মত আইনের শাসন ও সুশাসহীন দেশে শেষ অব্দি প্রকৃতির বিচারের ওপরই আমাদের ভরসা রাখতে হয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়