দোকানে বসা কয়েকজন। কথা বলছেন মামলা থেকে নাম কাটা নিয়ে। পাঞ্জাবি গায়ে যুবকের পাশে বসা আরেকজন। হঠাৎ একজনের কণ্ঠস্বর, ‘মোস্তফা ভাই, কেমন টাকা লাগবে? আজই এজাহার হয়েছে, কী করতে হবে? আমিনুল ভালো বলতে পারছে না।’ মোস্তফার জবাব, ‘এখানে আমি বাঁচানোর জন্য আসছি, ৬০ হাজার টাকা লাগবে। এর পর আর খরচ হইত না। একটি নাম কাটাতে এ টাকা লাগবে। টাকা দিলে ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যেই কাটা সম্ভব হবে।’ এর পর সবাই অন্য আলোচনায় মেতে ওঠেন।
গণমাধ্যমের হাতে আসা ৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ভিডিওর কথোপকথন এটি। এতে উঠে এসেছে, কিশোরগঞ্জে স্ট্রোক কিংবা হৃদরোগে মৃত ব্যক্তিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত দাবি করে ভুয়া মামলা ও টাকা কামানোর চিত্র। গত ২৭ জুলাই মারা যান দুলাল রবি দাস। আর ৪ আগস্ট মৃত্যু হয় রুবেল আব্দুল্লাহর। তাদের মৃত্যু সনদে লেখা কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে স্ট্রোকে মারা যান দুলাল। রুবেলের মৃত্যু হয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। কিন্তু দু’জনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত হয়েছেন দাবি করে ২৯ নভেম্বর সদর থানায় সমন্বয়ক পরিচয়ে মামলা করেন রাফিউল আলম।
এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৬৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। পরে দুলাল ও রুবেলের পরিবার হয়রানি এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলাটি করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালতের কাছে দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
জানা যায়, দোকানে বসা পাঞ্জাবি গায়ে মোস্তফা (মোস্তফা কামাল) গণঅধিকার পরিষদের কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সদস্য সচিব। তাঁর ভাষ্যে, পাশে বসা ব্যক্তি আমিনুল এলাকার বিএনপি নেতা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘মামলার এক আসামি মিলনের কাছে বিএনপি নেতা আমিনুল টাকা চান। দোকানে বসে কথা বলার সময় তিনি টাকা চাওয়ার বিষয়টি আমাকে বলেন। তাদের কথায় সায় দিয়ে টাকার কথা বলি।’
বাদী রাফিউল কিশোরগঞ্জ শহরের মনিপুরঘাট এলাকার জসিম উদ্দিনের ছেলে। এজাহারে তিনি ভিন্ন তিন ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ১৬ জুলাই প্রথম ঘটনায় সংঘর্ষ হলেও কেউ মারা যাননি। ১৮ জুলাই দ্বিতীয় ঘটনায় শহরের গৌরাঙ্গ বাজার মোড়ে ছাত্রদের মিছিলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গুলি চালালে দুলাল রবি দাস নামে এক মুচি গুরুতর আহত হন। পরে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। ৪ আগস্ট তৃতীয় ঘটনায় সদরের গুরুদয়াল কলেজ মাঠ এলাকায় আওয়ামী নেতাকর্মীর ছোড়া শর্টগানের গুলিতে নিহত হন রুবেল আব্দুল্লাহ।
তবে কিশোরগঞ্জ জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদনে দুলালের ছেলে বিকাশ দাস উল্লেখ করেছেন, আমার বাবা ২৭ জুলাই বিকেলে স্ট্রোক করেন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করার জন্যই এক দুষ্কৃতকারী মামলাটি করেছেন। আমরা তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
রুবেলের বাবা আজহারুল ইসলাম আবেদনে বলেছেন, ৪ আগস্ট আন্দোলনরত অবস্থায় রুবেল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাসপাতালে নিলে মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে কারও বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ নেই। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা আমাদের না জানিয়ে হয়রানিমূলক মামলা করেছে।
আশিকুজ্জামান আশিকসহ কিশোরগঞ্জ জেলার একাধিক সমন্বয়ক জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাদের জেলার মধ্যে যে পাঁচজন শহীদ হয়েছেন, তাদের মধ্যে দুলাল ও রুবেল নামে কেউ নেই। অবশ্য বিভিন্ন স্থানে কিশোরগঞ্জের অন্তত ১৬ আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে অন্তত ৪২টি মামলা হয়েছে। এতে ৩ হাজার ৫৫৯ জনের নামে ও অন্তত ১০ হাজারের বেশি অজ্ঞাতপরিচয়ের ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দুলালের ছেলে বলেন, ‘বাবার বয়স ৬৩, দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। তিনি কখনও আন্দোলনে অংশ নেননি। স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ায় আমরা মামলা করিনি। তবে আমাদের না জানিয়ে তাঁকে নিহত দেখিয়ে মামলা করাই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। থানা ও আদালতকে লিখিত জানিয়েছি।’ অন্যদিকে রুবেলের ছোট বোন খাদিজাতুল কুবরা সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা কোনো আইনি ঝামেলা চাই না। মামলার বাদীকে আমরা চিনি না। আমার ভাই আন্দোলনে অংশ নেন। কিন্তু কারও হামলায় মারা যাননি।’
এ বিষয়ে বাদী রাফিউলের দাবি, চার-পাঁচজন পরামর্শ করে মামলা করেছি। আমি ১৩০ জনের নাম দিয়েছিলাম। বাকি ৩৮ জনের নাম আইনজীবী শওকত কবির খোকন যুক্ত করেছেন। পরে হিসাব করে দেখেছি অন্তত ১৯ জন রয়েছেন নিরীহ ব্যক্তি ও বিএনপির নেতাকর্মী। এখন অনেকে আমার নাম ভাঙিয়ে আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা কামাচ্ছেন। সত্যের জয় হবে। আমি বিচার চেয়ে অন্যায় করলে শাস্তি মেনে নেব।
দুলাল ও রুবেলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মৃত্যু সনদে কী আছে জানি না। তবে আমি তাদের দুইজনকে মারা যেতে দেখেছি।’ মামলা ভাঙিয়ে বন্ধু পায়েলের সঙ্গে টাকা লেনদেনের বিষয়ে রাফিউল বলেন, ‘আমি টাকার কথা বলিনি। ভুলে নিরীহ যাদের নাম এসেছে, তাদের আইনি সহায়তা নিতে পায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।’
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঘটনা আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগ দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে মামলাটি ভুয়া কিনা বেরিয়ে আসবে। তখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’