শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্যাডারে ক্ষোভ, ৬৪ ডিসির প্রতিবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতির কোটা, বিসিএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারভুক্ত না রাখার বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তা মানতে নারাজ প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। পৃথক সভা ও বিবৃতিতে তাঁরা বলছেন, কমিশনের এমন সুপারিশ সমস্যা সৃষ্টি করবে।

গত মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এই কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে এ কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।

কমিশনের মঙ্গলবারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। এর পাশাপাশি দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বুধবার এ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। ৬৪ জেলার ডিসিরা পৃথক কার্যবিবরণী পাঠিয়েছেন।

রাতেই ঢাকায় বিশেষ বৈঠক করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন নেতারা। বুধবার প্রায় সব জেলাতেই এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ডিসিদের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন যে ধরণের সুপারিশ করার চিন্তা করছে, তা বাস্তবতা বিবর্জিত। এ ধরণের উদ্যোগ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রতিবেদন সরকারের নিকট জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এই ধরণের ঘোষণা অনভিপ্রেত, আপত্তিকর ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল।’

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবাদলিপিতে সই করেছেন সংগঠনটির সভাপতি ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ্‌ এবং মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।

বিবৃতিতে তারা বলেন, কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন প্রকাশ্য নিয়ে আসা হলো। সেই প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনের নেতারা। কোনো মহলের ইন্ধনে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস কি না, তা খতিয়ে দেখতেও বলছেন তাঁরা।

আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে সব সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৮ সালে জারি করা এক নীতিমালায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে। সেই নীতিমালায় ২৫ শতাংশ উপসচিব পদে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসকে আনুপাতিকভাবে কোটা প্রদান করা হয়।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতি। তারা বলেছে, এমন সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষা প্রশাসন এবং সংস্কার কার্যক্রমে স্থবিরতা এলে শিক্ষা ক্যাডার সমিতি কোনো দায় নেবে না।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিন এক বিবৃতিতে সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে অবিলম্বে এই প্রচেষ্টা বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছেন।

প্রতিবাদলিপিতে তারা বলেন, সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে কাঠামোর বাইরে রাখার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার সদস্যের একক মুখপাত্র বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এই সুপারিশ সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে অনুরূপ একটি প্রচেষ্টা আমরা প্রতিহত করেছি। বিষয়টি মীমাংসিত। সংস্কারের মাধ্যমে সব বৈষম্য নিরসন ও গতিশীল জনবান্ধব জনপ্রশাসন তৈরির লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের এ ধরনের সুপারিশ বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এ সুপারিশ প্রত্যাহার করা না হলে কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার ব্যর্থ হবে।

প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়, কমিশন নেতৃত্বের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে এমন প্রস্তাবনা তৈরি এবং গণমাধ্যমে একতরফাভাবে প্রচার করা সুবিবেচনা প্রসূত নয়। শিক্ষাখাতে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারকে অস্থিতিশীল করার এটি কোনো ষড়যন্ত্র কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিৎ।

বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন ও সদস্যসচিব উম্মে তানিয়া নাসরিন এক বিবৃতিতে এই সংস্কার প্রস্তাবকে ‘হঠকারী সুপারিশ’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বিবৃতিতে তারা বলেছেন, স্বাস্থ্যের নীতিনির্ধারণী পর্যায়গুলোতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুগোপযোগী না করে বরং উল্টো পথে হেঁটে আমলাতান্ত্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা কায়েম করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের দক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব বলে জানান তারা।

শেয়ার করুন