চাঁদপুরের মেঘনায় নোঙর করা সারবোঝাই একটি জাহাজ থেকে সাতজনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করেছে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে ৫ জনকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এর বাইরে গুরুতর আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
হাইমচরের ঈশানবালা খালের মুখ এলাকায় মেঘনা নদীর একটি ডুবোচরে এম ভি আল–বাখেরা নামের জাহাজটি নোঙর করা ছিল। সোমবার বেলা তিনটার দিকে নৌ পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রক্তাক্ত দেহগুলো জাহাজের কর্মীদের ঘুমানোর কক্ষে কক্ষে পড়ে ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। কারও কারও মাথায় গভীর ক্ষত দেখা গেছে। কারও কারও ছিল গলা কাটা। শরীরের অন্যান্য স্থানেও আঘাত ছিল।
নিহত ব্যক্তিরা জাহাজটির কর্মী। তাঁদের মধ্যে চারজনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন জাহাজের মাস্টার ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের গোলাম কিবরিয়া (৬৫), চালক সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল ও লস্কর সবুজ শেখ (২৬)। কিবরিয়া ও সবুজ মামা–ভাগনে। সালাউদ্দিন ও আমিনুলের বাড়ি নড়াইল বলে জানিয়েছে পুলিশ। গুরুতর আহত খালাসি জুয়েল ফরিদপুর সদর উপজেলার বকারটিলা গ্রামের সেকান্দার খালাসির ছেলে।
পুলিশ, জাহাজের মালিক ও সার পরিবহনকারী—কেউই হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি। সোমবার সন্ধ্যায় চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় বলেন, প্রাথমিক তদন্তে তাঁরা বিষয়টিকে ডাকাতি বলে মনে করছেন না। তাঁদের মনে হচ্ছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ, সেখানে দুটি মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এদিকে নৌশ্রমিকেরা বলছেন, মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ বালুমহালের ইজারার নামে চলন্ত বাল্কহেডের (বালু পরিবহনকারী নৌযান) গতিরোধ করে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ডাকাতি ও শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। জাহাজশ্রমিক হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে সোমবার নারায়ণগঞ্জে এক মানববন্ধনে বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন এবং নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুজ শিকদার বলেন, রোববারও মেঘনা নদীতে বেশ কয়েকটি বাল্কহেডে ও জাহাজে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে কর্মীদের মারধর করেছে।
ঘটনাটি ডাকাতি না শত্রুতার কারণে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল জাহাজটির মালিক দিপলু রানার কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে আসল ঘটনা বের করতে পারবে।’
রক্তাক্ত দেহ দেখে ৯৯৯–এ ফোন
চাঁদপুর ও শরীয়তপুরের মধ্য দিয়ে মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। ওই নদী দিয়ে বিভিন্ন জেলার পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে। চাঁদপুরের ঈশানবালা এলাকাটি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার পাশে। জাহাজটি নোঙর করা ছিল একটি নির্জন এলাকায়।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল জানায়, ১৯ ডিসেম্বর আল-বাখেরা নামের জাহাজটি ইউরিয়া সার পরিবহনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৮০০ মেট্রিক টন। জাহাজটির পণ্য পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজ। বরাদ্দ পাওয়ার পর জাহাজটিতে ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কাফকো জেটি থেকে ৭২০ টন ইউরিয়া সারবোঝাই করা হয়। রোববার ভোরে জাহাজটি সার নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হয়। এই সার ছিল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি)।
জাহাজটির মালিক দিপলু রানা বলেন, চট্টগ্রাম থেকে রওনা হওয়ার পর রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে জাহাজটির মাস্টারের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। তখন মাস্টার জানিয়েছিলেন, মেঘনা নদীতে তাঁরা জাহাজের বহরের মধ্যেই ছিলেন। তবে সকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ সাড়া দেননি। তিনি বলেন, ‘বারবার যোগাযোগ করে কাউকে না পেয়ে আমাদের আরেকটি জাহাজের (মুগনি-৩) নাবিকদের বিষয়টি জানাই। ওই জাহাজ এমভি আল–বাখেরার কাছাকাছি ছিল। তাঁরা আল-বাখেরার কাছে যাওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারেন।’
মুগনি-৩ নামের জাহাজটি চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। জাহাজটির চালক মোহাম্মদ বাচ্চু মিয়া বলেন, তিনি মালিকের ফোন পেয়ে বেলা একটার দিকে এমভি আল-বাখেরার কাছাকাছি যান। সেখানে গিয়ে আল–বাখেরায় থাকা তাঁর ভাতিজা জুয়েলকে ফোন করেন। কোনো সাড়া না পেয়ে মালিককে ফোন করেন তিনি। তখন মালিক জাহাজটিতে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য বলেন।
বাচ্চু মিয়া আরও বলেন, ‘এমভি আল-বাখেরায় গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পাঁচজনকে পড়ে থাকতে দেখেন আমাদের সুকানি রবিউল। তাঁরা জীবিত ছিলেন না।’ তিনি বলেন, ‘পাঁচজনের বাইরে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজন জাহাজে পড়ে ছিলেন। তাঁরা তখন ৯৯৯–এ ফোন করেন। এরপর নৌ পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।
নৌ পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনজনকে উদ্ধার করে চাঁদপুরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার আনিসুর রহমান জানান, হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। জুয়েল নামের একজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।
জুয়েলের বয়স ৩৫ বছরের আশপাশে। হাসপাতালে তিনি নৌ পুলিশকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শ্বাসনালি কাটা থাকায় বলতে পারছিলেন না। তিনি কিছু একটা লেখার চেষ্টাও করেন।
চাঁদপুর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম ইকবাল বলেন, ‘আমরা আহত জুয়েলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারেননি। একটি কাগজে শুধু তাঁর নাম আর একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছে।’
রাত আটটা পর্যন্ত খবর অনুযায়ী, পাঁচটি লাশ জাহাজে ছিল। চাঁদপুরের হাসপাতালের মর্গে ছিল দুটি লাশ। রাত নয়টার দিকে আহত জুয়েলকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছায়।
ময়নাতদন্ত শেষে মামলা
সন্ধ্যায় চাঁদপুর অঞ্চলের নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান বলেন, মরদেহ সুরতহালের কাজ শেষ করেছে পুলিশ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত দল আসার পর মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, নিহত ও আহত শ্রমিকদের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে মামলা করা হবে।
মুশফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছে আজ (সোমবার) ভোরে অথবা সকালের মধ্যে কোনো এক সময়। এটি আমাদের ধারণা।’ তিনি বলেন, ঘটনাস্থলটি নিরিবিলি। ঘটনা ঘটিয়ে দুর্বৃত্তরা সহজে পালিয়ে যায় বলে তাঁর ধারণা।
শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর সারুলিয়া ঘাট এলাকায় মানববন্ধনটির আয়োজন করে বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন এবং নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন সারুলিয়া ঘাট শাখা। এতে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে জাহাজশ্রমিকদের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার করা না হলে কর্মবিরতিসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এতে বক্তারা বলেন, নৌযানের শ্রমিকেরা অবৈধ বালুমহালের ইজারাদার ও তাঁদের পালিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ডাকাতদের কবল থেকে মুক্তি চান।