ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি ঘটছে? যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে, তা কি ভঙ্গ হচ্ছে?
একাত্তরে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মানুষ শুধু স্বাধীনতা পাবে না, মুক্তিও পাবে। কেননা, যুদ্ধটা ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ এবং এর লক্ষ্য ছিল সর্বাধিক মুক্তি অর্জন। মুক্তির জন্য আমরা প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ চেয়েছিলাম। সেই রাষ্ট্রে প্রধানত যেটা থাকবে, সেটা হলো অধিকার এবং সুযোগের সমতা। এই সাম্য আমাদের আগের রাষ্ট্রে ছিল না। আর অর্থনৈতিক মুক্তি, যেটা মুক্তির প্রাথমিক শর্ত, সেটা কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হলো। দেশ কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হবে, তা নয়; রাষ্ট্র মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করবে এবং সুযোগ ও অধিকার অবারিত হবে– এটাই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু সেসব স্বপ্ন বাহাত্তর সাল থেকেই ভঙ্গ হতে শুরু করে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানেরও প্রধান স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনোই এককেন্দ্রিক হবে না। রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার জায়গায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আসবে। অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং জনপ্রতিনিধিরা এই রাষ্ট্রের কর্তা হবে। আমলাতন্ত্র জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার লক্ষ্য থেকে বর্তমান সরকার ও তাদের সমর্থকরা কি ক্রমেই সরে যাচ্ছে?
পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র ছিল। ওই রাষ্ট্র ভাঙতই। এবং সেটি কেবল ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই নয়, ভাঙত বৈষম্যের কারণে। আশা ছিল, বাংলাদেশে বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আঞ্চলিক বৈষম্যের জায়গায় আমরা বাংলাদেশে পেয়েছিলাম শ্রেণিগত বৈষম্য। আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে শ্রেণিগত বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছিল। আশা ছিল, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্য দূর হবে। কিন্তু জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর যত দিন যাচ্ছে, অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠিত না করে রাষ্ট্র উল্টোদিকে যাচ্ছে। ক্রমাগত বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, ইতোমধ্যে তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ দেখছে। অল্প কিছু লোক ক্ষমতাবান ও ধনী হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের আমলে এক দল ক্রমাগত ক্ষমতাশালী ও ধনী হতো, এখন অন্য আরেক দল মানুষ হঠাৎ ক্ষমতাশালী ও ধনী হতে শুরু করেছে। আগে যারা ধনী হয়েছিল, তারা হঠাৎ ধনী হয়েছে; অবৈধ উপায়ে ধনী হয়েছে; ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে কেউ হয়েছে; কেউ হয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে; অনেকে পাচার করেছে বিদেশে। এসব লোকের দেশপ্রেম নেই। এখন যারা হঠাৎ অর্থ ও বিত্তবৈভব বাড়াচ্ছে, তারাও বৈধ পথে নয়। তারাও যে পাচার করবে না, সেই নিশ্চয়তা কী? আগের লোকদের যদি দেশপ্রেম না থাকে, এখনকার লোকদের দেশপ্রেম থাকার কী কারণ থাকতে পারে?
গত চার মাসে ‘মব’ সন্ত্রাস বেড়েছে। সন্ত্রাস তো আকাশ থেকে পড়ে না। সন্ত্রাসের বড় কারণ হলো বেকারত্ব। বেকার লোকের পক্ষে সন্ত্রাসী হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বেকারত্বের সঙ্গে মাদকাসক্তিও জড়িত। ধনী ব্যক্তিদের সন্তান থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত এই ভয়াবহ নেশায় আসক্ত। সেটিও কর্মহীনতার সঙ্গে জড়িত। মৌলবাদের সমস্যাও কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে যুক্ত। দারিদ্র্যের কারণে মানুষের জীবনে কোনো নিশ্চয়তা নেই, সুবিচার নেই। কোথাও কোনো দাঁড়ানোর জায়গা নেই। মানুষ তাই নির্ভরশীল হচ্ছে হয় আধিদৈবিক শক্তির ওপরে, না-হয় ক্ষুব্ধ হয়ে দল বেঁধে আধিপত্য দেখাতে যাচ্ছে।
ঐক্য ধরে রাখার কথাও বলছেন কেউ কেউ। ঐক্যের কথা বলতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে কার বিরুদ্ধে ঐক্য এবং কীসের জন্য ঐক্য। কার বিরুদ্ধে ঐক্য– সেটা একাত্তর সালে আমরা জানতাম। কার বিরুদ্ধে ঐক্য– সেটা আমরা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানকালে জানতাম। কার বিরুদ্ধে ঐক্য– সেটা আমরা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময়ও জানতাম। এখন কার বিরুদ্ধে ঐক্য– উত্তর সহজ নয়। কীসের জন্য ঐক্য, সেটাও কি পরিষ্কার?
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যও ছিল একই। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও আমরা একই লক্ষ্য সামনে রেখেছিলাম। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর সামনে কি এখনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে? নাকি কেবলই ক্ষমতা পাওয়া বা ধরে রাখাই মুখ্য হয়ে উঠেছে?
এটা অবিশ্বাস্য, লজ্জাজনক ও দুঃখজনক যে, অন্তর্বর্তী সরকারেও অপ্রত্যক্ষে জামায়াত কী করে এই রাষ্ট্রের শাসনে গুরুত্ব পায়? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা ছিল; সেই অবস্থান যে পরিত্যাগ করেছে– এমন কোনো ঘোষণা তারা দেয়নি। একাত্তর সালে তাদের ভূমিকার জন্য তারা জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। এখন রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। কেমনভাবে হলো? বর্তমান সরকার এদের সঙ্গে আঁতাত করল। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছিল আন্দোলনের নামে। চারদলীয় ঐক্যজোট তো নির্বাচনে জিতে তাদেরকে সরকারের অংশই করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার আঁতাত করেছে কীসের জন্য?
মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য থেকে সরে এসেছিল। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিএনপি সরকার তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নের কথা বললেও সেই অঙ্গীকার থেকে প্রথম সুযোগেই সরে এসেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার মুখে জোরে জোরে গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য বাস্তবায়নের কথা বলছে বটে, সেখান থেকে ইতোমধ্যে কি সরে আসেনি? বৈষম্য দূর করতে গিয়ে অধিকতর বৈষম্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপট কি তৈরি হয়নি? আওয়ামী লীগের অপরিমিত ক্ষমতা প্রয়োগ ও প্রদর্শন নেই বটে; নতুন আরেকটি গোষ্ঠী কি যত্রতত্র ক্ষমতা প্রদর্শন করছে না? গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলোও কি গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারছে?
একটি গণতান্ত্রিক সরকার হচ্ছে নির্বাচিত সরকার। কিন্তু নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক সরকার নয়। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন পরস্পর সহনশীলতা, মূল্যবোধ, মর্যাদা; সেটা বর্তমানের বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে রয়েছে? বাইরের কথা বাদ, দলগুলোর ভেতরেই কি গণতন্ত্র রয়েছে? আর দলেই যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে দেশে গণতন্ত্র আসবে কীভাবে? যে আমলেই হোক, শাসক শ্রেণির আদর্শগত অবস্থানও মৌলিকভাবে অভিন্ন। তারা আসলে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। ক্ষমতা দখল করা মূল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালে সহনশীলতা বা ধৈর্য থাকে না।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়