নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। মনে করা হয়, পুরাতন বছরের দিনগুলো নতুন বছরে গিয়ে বদলাবে। কিন্তু বদলায় না; এবং বদলায় না যে– সেই পুরাতন ও একঘেয়ে কাহিনিই নতুন করে বলতে হয়। না-বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই; বারবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল হইনি।
মুক্তি যে আসেনি, তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্র ব্যর্থতার স্মারকগুলো জ্বলজ্বল করে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দু’একটি ঘটনা ঘটে, যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি। পরস্পরকে বলি যে, আমরা তো ভালো নেই; কঠিন বিপদের মধ্যে!
বিদ্যমান ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি। যে জন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের; তারাও যে নিরাপদে রয়েছে, তা নয়। বেশির ভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এই ব্যবস্থাকে যে বদলাতে পারব না, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। যা প্রয়োজন তা হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
সেটা না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না এবং সবাই আধমরা হয়েই থাকব, এখন যেমনটা রয়েছি।
নানা প্রত্যাশা, স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা আমরা প্রতি নতুন বছরের আগমনে করে থাকি। এবারেও তেমন প্রত্যাশা করছি বৈ কি। তবে দেশের সার্বিক অবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছে। বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগের বিদায়ের মধ্য দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের পথ খুলেছিল, ভেবেছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কবে হবে, সে নিয়ে বর্তমান সরকার এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নির্বাচনই সবকিছু কিনা– সেই প্রশ্নও আছে। প্রতি পাঁচ বছরান্তে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পর্যায়ক্রমে একবার এই দল, আরেকবার ওই দল ক্ষমতায় বসার নিয়ম। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলো যে একে অপরের বিকল্প নয়– এ সত্য বারবার প্রমাণিত। প্রকৃত বিকল্পের অভাবে জনগণ একই বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে। বাংলাদেশে এ যাবৎকালের একটি নির্বাচনও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় জনগণের মুক্তি অসম্ভব। এ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া জনগণের ভাগ্য বদল হবে না। বিদ্যমান জনবিরোধী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে শাসক শ্রেণির মধ্যে ন্যূনতম বিরোধ নেই; নেই মতপার্থক্য। বরং ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তারা একমত।
সমাজের সর্বত্র চলছে হীন প্রতিযোগিতা। কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে; কাকে ধাক্কা দিলে নিজের অর্জন নিশ্চিত হবে, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ঘটনা। ব্যক্তির উন্নতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমষ্টি ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, যা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে না। আসবে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের পথে। আমরা এমন ব্যবস্থা চাই, যা মানুষকে আশাহীন এবং ভবিষ্যৎহীন করবে না; সবার জন্য অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করবে। সে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের পরিত্রাণ নেই।
এটা বললে অন্যায় হবে না, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি, আসলে তা ছিল সমাজ বিপ্লবেরই চেতনা। বছরের বিদায়ী মাসে ভাষা-সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্মৃতিগুলো ফিরে আসে। বিশেষ করে এই কারণে যে, সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ অঙ্গীকার আজও অপূর্ণ কিংবা ব্যর্থ। প্রাপ্তি কেবলই স্মৃতির সুখ-দুঃখে বহমান। হ্যাঁ, অর্জন অবশ্যই ঘটেছে, যা জাতি স্বাধীন না হলে ছিল দূরকল্পনা। যেমন অর্জন হয়েছে নগরায়ণে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, উঁচু বাড়ি আর সুপারমার্কেট। নগরের ধারণক্ষমতার বাইরে নতুন-পুরাতন গাড়ি আমদানি, পরিবেশ বিপর্যয়। মানুষ তো অবশ্যই, নগরের এমন একটি গাছ বা লতাগুল্মের সবুজ পাতা নেই, যা বিষাক্ত গ্যাস, বর্জ্য আর ধুলায় আচ্ছাদিত নয়। ওরা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজেও স্বাভাবিক স্বাধীনতা হারিয়েছে। আগের তুলনায় জনগণের স্নায়ুর ওপর চাপ যে শত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ অস্থির, দুশ্চিন্তায় পতিত। বলতে গেলে মানসিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় বিব্রত। জাতীয় জীবনে এই যে মানসিক বিপর্যয়, এটি জাতীয় সম্পদের বিনাশের যে কোনো মাত্রার চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়।
পুরাতন বছর পার হয়ে নতুন বছরে পদার্পণে রাজনৈতিক জমা-খরচের অনেক হিসাবই মিলবে না। আমরা বর্তমানে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ইতিহাসে ক্রান্তিকালের শেষ নেই। মানুষ সব সময়ই নতুন কালে পৌঁছতে চায়। সেই পৌঁছতে পারা-না পারাই বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতার পরে আমরা কতটা এগিয়েছি, পিছিয়েছি কতটা– সেই জিজ্ঞাসা আমাদের আছে এবং থাকাটা জরুরিও বটে।
অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, মানুষের নিরাপত্তা একেবারেই বাড়েনি। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল করার যে চেষ্টা তা কোনো দেশে কখনও কার্যকর হবার নয়, হবেও না। মব ট্রায়ালের ঘৃণ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার থেকে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা, শিক্ষক এমনকি বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও বাদ পড়েনি। একাত্তরের পরাজিত শক্তির উত্থান ঘটেছে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে। এগুলো কিন্তু অশুভ বার্তারই আলামত। এতে রাষ্ট্র ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও অস্পষ্ট থাকেনি।
ওদিকে রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। শাসক শ্রেণির রাজনীতি যে কতটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে, এ তারই নতুন প্রমাণ। জনগণ এদের সঙ্গে নেই। কিন্তু জনগণের সামনে কোনো বিকল্পও নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির আসল সংকট এটাই। অনেক হট্টগোল করে সরকার শেষ পর্যন্ত একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশন যে কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিকট ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বস্তুত বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার কোনো কিছুর ওপরেই মানুষের আস্থা নেই। তবুও যে তারা টিকে আছে, তার কারণ জনগণ সংঘবদ্ধ নয়।
শিল্প হোক, সংস্কৃতি হোক, রাজনীতি হোক– সবারই দাঁড়াবার ভূমি হচ্ছে অর্থনীতি। পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিশ্বময় আজ ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য চলছে তা মোটেই বিচ্ছিন্ন একান্ত দেশীয় কোনো বিষয় নয়; আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক মহাদানবীয় তৎপরতারই অবিচ্ছিন্ন অনিবার্য ফল। কেবল এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকা নয়, সাম্রাজ্যবাদ তার জন্মভূমি ইউরোপেও আগ্রাসী থাবা বিস্তার করেছে। জাতিসংঘকে কেবল নির্বীর্য করেই থেমে থাকেনি, দুর্নীতি আর ঘুষ কেলেঙ্কারিতেও ডুবিয়ে দিয়েছে। তবে মানুষের ভরসা কোথায়? ভরসা হচ্ছে সম্মিলিত ও সুসংগঠিত প্রতিরোধে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়