বৈশ্বিক শৃঙ্খলা কিছুদিন ধরে ভেঙে পড়েছে। ইতোমধ্যে পশ্চিমা আধিপত্য ক্ষয় এবং বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি চাপে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বশক্তি বহু ধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তনের পাটাতনে মধ্যপন্থি শক্তিগুলোর ভূমিকা ভূরাজনীতি গঠনে দিন দিন বাড়বে।
২০২৫ সালের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো, সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বৈশ্বিক বিষয়ে আরও অস্থির সময় শুরু হবে কিনা? তাঁর কিছু নীতি-পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বিশৃঙ্খল বিশ্বের জন্য আরও বিপর্যয়কর হওয়ার শঙ্কা জাগায়। ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র, প্রতিপক্ষ ও প্রতিযোগীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, তা দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির মধ্যে ভূরাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপার বোঝা যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিধারা আগামী বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দিক। ট্রাম্পের অনাকাঙ্ক্ষিত ও পরিবর্তনপ্রবণ ব্যক্তিত্বের কারণে চীন-মার্কিন সম্পর্কে হয় উত্তেজনা বাড়বে, নতুবা বড় ধরনের দরকষাকষি দিয়ে ট্রাম্পের লেনদেন চালিত হবে।
ট্রাম্পের বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ নিয়ে ওয়াশিংটন কতটা এগিয়ে যাবে, তা চীন-মার্কিন সম্পর্কের পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে বিশেষ করে চীন ইতোমধ্যে ট্রাম্পের সম্ভাব্য বাধা এড়াতে উপায় বের করতে কাজ শুরু করেছে। দ্য ইকোনমিস্টের বার্ষিক প্রকাশনা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড ইন ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে বাণিজ্য বাধা অতিক্রম করার পাশাপাশি গ্লোবাল সাউথের নতুন বাজার ধরতে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্ল্যাকরকের একটি মূল্যায়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নতা উচ্চ ঝুঁকি হিসেবে দেখেছে।
২০২৫ সাল ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ কোন দিকে যাবে তাও নির্ধারণ করবে। ইউক্রেন সম্পর্কে নীতিগত বিষয়ে আমূল পরিবর্তনে ট্রাম্পের পরামর্শ ইউরোপীয় সরকারগুলোকে বিচলিত করে তুলছে বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্প প্রায়ই দাবি করেন, তিনি ‘এক দিনে’ যুদ্ধ শেষ করতে পারেন। তিনি ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ঠেলে দেবেন বলে মনে হচ্ছে, যদিও তিনি সংঘাতের অবসান ঘটাতে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেননি। ট্রাম্প হয়তো এমন কোনো আলোচনার ফলাফলের বিরুদ্ধাচরণ নাও করতে পারেন, যা মস্কোকে সুবিধা দেয় এবং যার দ্বারা ইউক্রেনকে ভূখণ্ড হস্তান্তর করতে হয়।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের অবসান এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে চান। যদিও তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, তবে এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে ইসরায়েলের শর্তে ঘটবে। তিনি বলেছেন, সিরিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরে থাকা উচিত, তবে সেখানে শাসক পরিবর্তনের জটিল আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এটি কীভাবে সম্ভব, তা বুঝতে পারা কঠিন।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি থাকবে। পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে প্রত্যাশিত প্রবণতা উৎসাহব্যঞ্জক হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেক দেশে চলমান রাজনৈতিক মেরূকরণ এবং ক্রমশ ভেঙে পড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে মধ্যপন্থায় ক্ষয় ধরা অথবা এর বিনাশ, দুর্বল হয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখন বিশ্বজুড়ে। এটি ডানপন্থি জনতুষ্টিবাদের উত্থানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যা ইউরোপের বেশির ভাগ অংশে অব্যাহত ও অন্যত্র স্পষ্ট।
বাণিজ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ‘গ্লোবাল ট্রেড রিভিউ’ আগামী বছর শীর্ষ ঝুঁকিগুলোর একটিকে ‘ধূসর অঞ্চল আগ্রাসন’ বলে চিহ্নিত করেছে। তাদের মতে, ‘এটি এমন এক হুমকি, যা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। তবে স্বীকৃতি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’ এর মধ্যে রয়েছে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা, সাইবার অ্যাটাক ও প্রক্সি যুদ্ধ। সব পরিস্থিতি ‘প্রথাগত সংঘাত ও শান্তিকালীন পদক্ষেপের মধ্যকার সময় অবস্থা কী হবে তা অস্পষ্ট করে তোলে।’ যুদ্ধের এসব নতুন রূপ এখন সর্বব্যাপী। এর সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা ও কল্পনাশক্তি বাড়ানোও চ্যালেঞ্জিং। এ ছাড়া ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বা অত্যন্ত পরিণতিমূলক ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে রূপান্তর ঘটাতে পারে, যা থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে।
২০২৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অগ্রগতি ঘটার প্রবণতা দেখা যেতে পারে। ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন, মিডিয়া, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যক্তিগত জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সরঞ্জামের ব্যবহার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হবে। ইতোমধ্যে এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এতে সাইবার নিরাপত্তাসহ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের একটি যুগ শুরু হয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে আরেকটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।
আগামী বছর বিশ্ব ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াবে, এতে জাতিগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতার পাশাপাশি সর্বজনীন সমস্যার যৌথ মোকাবিলায় এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্ষমতা বিচারের মুখোমুখি হবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত; ডন থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম