বৈষম্যবিরোধী ছাত্র পরিচয়ে ময়মনসিংহে ডিআইজির অফিসে ‘হুমকি-বিশৃঙ্খলা’

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয় দিয়ে ময়মনসিংহ পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) অফিসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন একদল শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সাগর হত্যা মামলার আসামি মহানগর জাসদের সভাপতি ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা ইস্যুতে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ছিলেন উল্লেখ করলেও এ ঘটনার দায়ভার নেননি ছাত্র সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

গত ২৮ ডিসেম্বর বেলা ১২টার দিকে ডিআইজির অফিসে এই অপ্রীতিকর ঘটনার ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, ওই সময় চেয়ারে বসে থাকা পুলিশের উপমহাপরিদর্শক আশরাফুর রহমানের সামনে হইচই করছেন বেশ কয়েকজন। কেউ তাঁকে উচ্চ স্বরে ধমকান, কেউবা অভিযোগ করেন, কেউবা প্রশ্ন করে জবাব চান। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনার কোনো সুরাহা হয়নি।

৬ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও গত বুধবার নিজের ফেসবুক আইডিতে (ভেরিফায়েড নয়) শেয়ার করেন ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সাগর হত্যা মামলার আসামি তিনি।

ভিডিওটি আপলোড করে মোহিত উর রহমান শান্ত লেখেন, ‘আমাদের ময়মনসিংহের ডিআইজি সাহেবের সাথে মেধাবীদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময়’।

সেই ভিডিওতে শোনা যায়, শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘আপনি (ডিআইজি) প্রতি সপ্তাহে কেন বাড়িতে যান, তারাকান্দার ওসি আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ময়মনসিংহে নিহত রেদুয়ান আহমেদ সাগর হত্যা মামলার আসামিরা কেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’

এ সময় ডিআইজি আশরাফুর রহমানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাদানুবাদ হয়। এর আগে সংশ্লিষ্ট অফিসে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে ডিআইজির কক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা যায় ওই ভিডিওতে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। এই ঘটনায় ফ্যাসিবাদী চক্রের ইন্ধন রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, জেলা পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সাগর হত্যা মামলার আসামি মহানগর জাসদের সভাপতি ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। ওইদিন রাতেই তাঁকে ছাড়াতে থানায় যায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ে একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তারা ওই কাউন্সিলরকে ছাড়তে পুলিশকে চাপ দেয়। কিন্তু গ্রেপ্তার কাউন্সিলর মিন্টু সাগর হত্যা মামলার এজহারভুক্ত আসামি হওয়ায় তাঁকে ছাড়তে পুলিশ অপারগতা প্রকাশ করায় তারা ক্ষুব্ধ হন। মূলত ওই ঘটনার জের ধরেই পরদিন ২৮ ডিসেম্বর ওই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ডিআইজি অফিসে গিয়ে তান্ডব সৃষ্টি করে বলে দাবি করা হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটি সূত্রের দাবি, ডিআইজি অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শিক্ষার্থীরা সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও সাবেক শিবির নেতা মেহেদী হাসান তারেকের সহযোগী। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রলীগের বর্তমান পদধারী ও ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। তারা এর আগে বিআরটি অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে, সদর উপজেলার অফিস কর্তার সঙ্গে বেয়াদবিসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর মধ্যে ডিআইজি অফিসের ঘটনায় ছিলেন ছাত্র সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সহযোগী সাইবে রাকাত, আল নূর আয়াশ, ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মাহাদী হাসান তারেক, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মী মেহেদী হাসান সিয়াম, ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের ওয়ার্ড শাখার সহসভাপতি সাকিব হাসান রিমন, ছাত্রলীগ কর্মী রোহান, অলি উল্লাহ, হৃদয় ও ছাত্রদল কর্মী রাকিবুল ইসলাম ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী নিহাল।

এ বিষয়ে ছাত্র সমন্বয়ক ও গণঅধিকার পরিষদের সাবেক নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিল, তারা সবাই আমাদের লোক। তাদের সঙ্গে একসাথে আন্দোলন করেছি, চলাফেরা উঠাবসা করি। তবে ডিআইজি অফিসে আমি যাইনি। সেখানকার ঘটনার দায়ভার আমার না, ওই ঘটনার ভালোমন্দের দায় তাদের। কাউন্সিলর মিন্টুর দুই ছেলে আমাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। তাই তার বাবা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমাকে জানালে আমরা কয়েকজন থানায় গিয়েছিলাম, কী অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানতে। আমি তাকে ছাড়াতে যাইনি। তবে আমার অনুরোধ ছিল, তার সাথে যেন অন্যায় না করা হয়।’

ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মাহাদী হাসান তারেক বলেন, ‘আমি এই ঘটনার কিছু জানি না। তবে ছেলেরা ডিআইজি অফিসে গিয়েছে, এমন খবর পেয়ে আমি তাদের ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম।’ তবে জামায়াত ও শিবিরের একাধিক নেতা বলেন, মাহাদী হাসান তারেক আগে শিবিরের সাথী ছিল। এখন আর তাঁর সাথে শিবিরের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।

ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত দাবি করে ছাত্র আন্দোলনের অন‍্যতম সমন্বয়ক গোকূল সূত্রধর মানিক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম‍্য নয়। এটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাবিরোধী কাজ। আমি চাই, ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা নেওয়া হোক।’

এই বিষয়ে ডিআইজি আশরাফুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। এটি আন্দোলনের চেতনাবিরোধী কাজ। মূলত আওয়ামী দোসরদের ইন্দনে একটি গ‍্যাং এর আগেও বিভিন্ন সরকারি অফিসে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। এটা কাম‍্য নয়।’

ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) আখতার উল আলম জানান, ‘আমি এই জেলায় নতুন জয়েন করেছি। ডিআইজি অফিসের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এদের পেছনে কারা জড়িত এবং কী উদ্দেশ্যে এটা ঘটিয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শেয়ার করুন