আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর পেরিয়ে চার বছরে পদার্পণ করবে। বাংলাদেশে বসে এই সময়ে এই যুদ্ধের প্রতি এখন ততটা আগ্রহ দেখাবে না কেউ। দীর্ঘদিন এই যুদ্ধ চলার পর স্বাভাবিকভাবে মানুষ এটাকে নিত্যনৈমিত্তিক একটা ব্যাপার হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিছুদিন আগে মানুষের দৃষ্টি ছিল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের দিকে। এরপর ইসরায়েল-ইরান, ইসরায়েল-লেবাননের দিকে চোখ গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এসব যুদ্ধ এখনো চলমান আছে, একেবারেই মরণঘাতী যুদ্ধ। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার মাঝে আবার ঘটে গেল সিরিয়ার অভ্যুত্থান। দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদ রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলেন মস্কোতে। আপাতত সবার দৃষ্টি সিরিয়ার ওপর। এ কথা অনেকটাই সত্য যে বাশার আল-আসাদের সরকার সামরিক দিক থেকে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল রাশিয়ার সাহায্যের ওপর। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই ভরসাতেই ছিল বাশার আল-আসাদ। সেই ভরসা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি বাশারকে। তবে সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি আগের মতোই আছে। সিরিয়ার বর্তমান প্রশাসকেরা রাশিয়াকে তার ঘাঁটি আগের মতো অটুট রাখার জন্য অনুরোধ করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান আছে। এই যুদ্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ হতো না। আরও বলেছিলেন, তিনি যদি নির্বাচনে বিজয়ী হন, ক্ষমতা গ্রহণের আগেই এই যুদ্ধের ইতি ঘটাবেন। বস্তুত কিছুই হয়নি। যুদ্ধ চলমান আছে। আগের মতোই টানটান উত্তেজনার মধ্যে দুই পক্ষই আক্রমণ করে যাচ্ছে যে যার সুবিধামতো। শেষ মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসন ৮ বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের অনুমতি দিয়েছে ইউক্রেনকে, অবশ্য এই অর্থ ছাড় করতে হাউস অব কমনস ও সিনেটের অনুমোদন লাগবে।
আমেরিকার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব এসেছিল, রাশিয়া ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল দখল করে আছে, সেটা স্থিতাবস্থায় থাকবে, ন্যাটোতে আগামী ২০ বছর ইউক্রেন যোগ দিতে পারবে না। তবে ইউক্রেনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেনা মোতায়েন থাকবে। রাশিয়া এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।
এখানে একটি জিনিস লক্ষণীয়, রাশিয়া যেসব ইউক্রেনীয় জায়গা এখন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সেসব জায়গাকে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব জায়গা তারা মুক্ত করেছে। এসব জায়গায় রাশিয়ানদের ভাষায়, ইউক্রেনীয় নিউ নাৎসি বাহিনী জোরপূর্বক রাশিয়ান ভাষাভাষী মানুষের ওপরে অন্যায় অত্যাচার করেছে, নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা বা স্বাধীন মত প্রকাশে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এই অন্যায় অত্যাচার থেকে এসব অঞ্চলকে রাশিয়া স্বাধীন করেছে। এই ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তি ও ইউক্রেনীয় প্রশাসন বলছে, রাশিয়ানরা তাদের জায়গা জবরদখল করছে। এটাই এই যুদ্ধের দুই পক্ষের ভিন্ন মত, যার ফলে যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমান অবস্থায় ইউক্রেন আমেরিকায় তৈরি দূরপাল্লার মিসাইল ব্যবহার করছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে এমনকি মস্কো ও মস্কোর আশপাশেও তারা মিসাইল ব্যবহার করছে। কিছুদিন আগে কাজানে তারা দূরপাল্লার মিসাইল ব্যবহার করেছে। ইউক্রেন থেকে কাজানের দূরত্ব ৮০০ কিলোমিটার।
রাশিয়ার বড় শহরগুলো, যেমন মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, রোস্তভ, ক্রাসনাদার, ইকাতেরিনবুর্গ যেন আক্রান্ত না হয়, সেই ব্যাপারে অ্যান্টি-মিসাইল প্রোটেকশন তৈরি করেছে। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ, সর্বত্র এ রকম অ্যান্টি-মিসাইল প্রোটেকশন তৈরি করা হয়তো সম্ভব হয়নি। তাই ইউক্রেন মাঝে মাঝে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে ওইসব জায়গায়।
রাশিয়া যেসব শহর বা অঞ্চল মুক্ত করেছে, সেসব জায়গায় গণভোটের মাধ্যমে তা নিজেদের রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিয়েছে। কুরস্ক অঞ্চলের ৬৫ শতাংশ জায়গা ইতিমধ্যে রাশিয়া মুক্ত করেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী এখানে কোণঠাসা অবস্থায় আছে।
বিশ্ববাসী এখন দেখার অপেক্ষায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পর কী অবস্থায় পৌঁছাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য, ইউক্রেনকে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আর্থিক ও সার্বিক সাহায্য বর্ধিত করেছিলেন। জো বাইডেন তাঁর ক্ষমতার শেষ সময় এসে এ রকম সাহায্য-সহযোগিতা বৃদ্ধি করার কারণ কী? সবাই বলছে, কারণ একটাই, ডেমোক্র্যাটদের ভবিষ্যতের আলো বাঁচিয়ে রাখা।
হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, রাশিয়াকে কিছু অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে হলেও ইউক্রেনের উচিত যুদ্ধ বন্ধ করা। শত বছর বয়সে এসে হেনরি কিসিঞ্জার বুঝতে পেরেছিলেন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে কখনো ইউক্রেন জিতবে না। রাশিয়াকে যে কিসিঞ্জার চিরশত্রু মনে করতেন, সেই হেনরি কিসিঞ্জার পর্যন্ত ইউক্রেনকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। জেলেনস্কি বাইডেন সাহেবের কথায় ও ন্যাটোর আশ্বাসে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন। ডিসেম্বরের মাঝামাঝির দিকে রাশিয়া একটি অত্যাধুনিক মিসাইল ব্যবহার করেছে, যে মিসাইল আগে কখনো ব্যবহার করে নাই। রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে এর চেয়েও অনেক শক্তিসম্পন্ন মিসাইল তাদের মজুত আছে, বিশ্ব যা কোনো দিন কল্পনা করতেও পারে নাই, প্রয়োজন হলে সেই সব অস্ত্র ব্যবহার করবে। তারপরেও এই যুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয়, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড আক্রান্ত হয় আমেরিকার মিসাইল দ্বারা, তাহলে রাশিয়া শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে পা বাড়াবে কি না সেটা ভেবে দেখার বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুতিন এখন একটু দম নিচ্ছেন ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর কী করেন, তা দেখার জন্য।।
ট্রাম্প যদি শপথ নিয়ে, জো বাইডেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে পুতিন তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। রাশিয়াকে যাঁরা জানেন, পুতিনের মনোভাবের ওপর গত ২২ বছরে যাঁরা নজর রেখেছেন, অবশ্যই তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে পুতিন পিছু হটার পাত্র নন। তাই নতুন প্রশাসন আমেরিকার মসনদে বসলে সবার প্রত্যাশা থাকবে, অতি দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে জেলেনস্কিকে বোঝানো যে এই যুদ্ধে তারা কখনোই জিততে পারবে না। রাশিয়া যে প্রতিশ্রুতি তার জনগণের কাছে দিয়েছে, সেটা যে করেই হোক বাস্তবায়ন করবেই। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে, রাশিয়াও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। রাশিয়ার সম্পদ ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে হয়তো অদূরভবিষ্যতে এসব ক্ষতি পূরণ করতে পারবে, কিন্তু ইউক্রেন শতাব্দীর পর শতাব্দী এই যুদ্ধের খেসারত দিয়ে চলবে।
শান্তিকামী বিশ্ববাসী আশা করবে, ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি যেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর যা-ই হোক না কেন, ট্রাম্পের একটি সুনাম আছে এই বলে যে ট্রাম্প যুদ্ধবাজ না, নতুন করে যুদ্ধ কখনো আরম্ভ করেন না।
লেখক : প্রকৌশলী