দেশে এখন ঐক্যের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঐক্য যে প্রয়োজন– সেটা স্পষ্ট। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান তো ঐক্যেরই জয়। তবে সাময়িক ঐক্য মাত্র। স্থায়ী, যথার্থ ও কার্যকর ঐক্যের জন্য প্রথম বিবেচ্য হলো কার বিরুদ্ধে ঐক্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শত্রু সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত ছিল: ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এর পরের ঐক্য কার বিরুদ্ধে? শত্রু কে?
কথা না বাড়িয়ে বলা যায়, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদের ফ্যাসিবাদী রূপ; ডোনাল্ড ট্রাম্পরা যার সুবিধাভোগী, রক্ষক ও প্রতিনিধি। আমাদের দেশে শেখ হাসিনার সরকারও ছিল সে-ধারারই। হাসিনা চলে গেছেন; আশা করা যাচ্ছে, দেশে একটি নির্বাচন হবে এবং সে-নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু কারা আসবেন নির্বাচিত হয়ে?
একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি একটি প্রস্তাবনা দেখালেন। দেখলাম, তাঁর বিশ্লেষণ সঠিক। তিনি বলছেন, দেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত; একদিকে শতকরা ২০ জন, অন্যদিকে ৮০ জন। যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তারা যে দলেরই হোন, প্রতিনিধিত্ব তো করবেন মাত্র ২০ জনেরই। এ রকম ব্যবস্থা কোনোমতেই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। তাহলে কী করা যেতে পারে? তাঁর সমাধান হচ্ছে ২০ জন এবং ৮০ জন আলাদাভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, যাতে ২০ জনের প্রতিনিধি ৮০ জনের ওপর কর্তৃত্ব করতে না পারেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে? এখানে এসে তিনি নিশ্চুপই হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন, ২০ এবং ৮০’র বিভাজনটা যদিও আড়াআড়ি-ওপরে এবং নিচে; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন ও চরিত্র হচ্ছে খাড়াখাড়ি বিভাজনের; সেখানে প্রতিটি দলের নেতৃত্বই খাড়াখাড়ি দণ্ডায়মান। ওপরে বসে থাকা বুর্জোয়ারাই নেতা; জনগণ তাদের সমর্থক। খাড়াখাড়ি দাঁড়িয়ে এক দল অপর দলের প্রতিপক্ষ বটে, কিন্তু দলের ভেতর ২০ জনের প্রতিনিধিরাই নেতা; ৮০ জন দলের প্রতিনিধিদের সেখানে উপস্থিতিই নেই।
সমাধান একটাই। সেটা হলো ৮০ জনের দলের স্বতন্ত্র অবস্থান চাই– বুর্জোয়া দলগুলোর বিপরীতে নয় শুধু, তাদের বিরুদ্ধেই। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের ঐক্য চাই, বুর্জোয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে। বুর্জোয়া রাজনীতি কেবল সেক্যুলার দলগুলোই যে করে, তা নয়; ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকরাও একই পথের পথিক। তারাও সম্পদের ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস করে এবং সমাজতন্ত্রীদের পহেলা নম্বরের শত্রু জ্ঞান করে থাকে। সেক্যুলার বুর্জোয়ারাও সমাজতন্ত্রবিরোধী। তাদের ভাষা কিছুটা ভিন্ন ধরনের; এই যা।
ঐক্য তাই দরকার সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের মানুষদের। অর্থাৎ ৮০ জনের ঐক্য ২০ জনের বিরুদ্ধে। এই ঐক্যের লক্ষ্য হওয়া চাই সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করে পুঁজিবাদ-ফ্যাসিবাদকে স্থায়ীভাবে বিতাড়ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যটা গড়ে উঠতে পারে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে; প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর যুক্তফ্রন্ট গঠন করার মধ্য দিয়ে। যুক্তফ্রন্ট আমরা আগেও দেখেছি। যেমন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট। সেটা ছিল হযবরল ধরনের নির্বাচনী জোট। ওই জোট গঠনে সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন কমিউনিস্টরা। কিন্তু তারাই বাদ পড়ে যান সবার আগে, নেজামে ইসলামের আপত্তির কারণে, যে-পার্টির উদ্ভব ওই জোট গঠন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই।
এবারের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী জোট হবে না। হবে আন্দোলনের যুক্তফ্রন্ট। এই যুক্তফ্রন্ট প্রয়োজনে নির্বাচনে অংশ নেবে, যাতে জনসংযোগ, আদর্শ প্রচার এবং সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা যায় সেই লক্ষ্যে। যুক্তফ্রন্ট কেবল কেন্দ্রে থাকবে না, গঠিত হবে প্রতিটি শহরে, পাড়ায়, মহল্লায়। গঠিত হবে বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ঊনসত্তরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যেভাবে গঠিত হয়েছিল তার চাইতেও সুগঠিত, সুবিস্তৃত এবং স্থায়ী আকারে। সমাজতন্ত্রপন্থি দলগুলোর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ঐক্যবদ্ধ হবে। যুক্তফ্রন্টের প্রতিটি শাখাই কাজ করবে নিজেদের উদ্যোগে; কেন্দ্র থেকে প্রচারপত্র, সাহিত্য, সংগঠক ইত্যাদি প্রেরণ করা হবে। বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে তরুণদের যুক্ত করার ব্যাপারে। সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক জাগরণও চাই; পাঠাগার পাওয়া গেলে তাকে ব্যবহার করা যাবে সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু কোনো কাজই মতাদর্শিক লক্ষ্যবিহীন হবে না। লক্ষ্যটা হবে দেশে সামাজিক বিপ্লব, যেটা ঘটেনি; কিন্তু যার জন্য দেশের মানুষ প্রতীক্ষায় রয়েছে।
সমাজতন্ত্রীরা সুযোগ হারিয়েছেন ছেচল্লিশে; হারিয়েছেন একাত্তরে। তিপ্পান্ন বছর পরে আবার সুযোগ এসেছে; ধারণ করতে না পারলে শূন্যস্থান পূরণ করবে অন্যরা। সমাজতন্ত্রীদের আওয়াজটা হবে– ঐক্য চাই সমাজ বদলের জন্য। কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ছিল কেবল কোটা-বৈষম্য নিরসনে। কিন্তু মানুষ সেটিকে সামাজিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করেছে। এই ঘটনাই বলে দিচ্ছে– রাষ্ট্র ও সমাজে যে পুঁজিবাদী বৈষম্য বিদ্যমান, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষ প্রস্তুত। অপেক্ষা কেবল আহ্বানের। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন দাবি নিয়ে যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে; অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে চারদিকে; তাতে বুঝতে অসুবিধা নেই– সমাজ পরিবর্তনের সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। আর পুঁজিবাদ যে সংশোধিত হয়ে হিংস্রতা ভুলে মানবিক হয়ে পড়বে– এমন আশা দুরাশা মাত্র। পুঁজিবাদ আগামীতে আরও নৃশংস হবে, যদি না তাকে বিদায়ের আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরিণতিতে তাকে বিতাড়িত করে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা না যায়।
একটি খবর পাওয়া গেল। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে জামায়াতপন্থি কয়েকজন মিলে প্রকাশ্যে মারধর করেছে। তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ছেড়ে যাবার হুকুমনামা জারি করেছে। আবদুল হাই নামের এই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিতে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন, তাঁর বয়স এখন ৭৮; তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু স্থানীয় এমপি ও দলীয় মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে বসতবাড়ি ত্যাগ করে আট বছর ফেনীতে গিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আওয়ামী সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের এলাকায় ফিরে এসেছিলেন; আসার পরে এই বিপত্তি। তাঁর ওপরে হামলায় নেতৃত্ব দেয় জামায়াতের এক প্রবাসী সদস্য এবং লাঞ্ছনার দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে সেটি প্রচার করা হয়েছে তারই উদ্যোগে।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই দুর্দশার জন্য দায়ী কে? দায়ী বিগত বুর্জোয়া সরকারগুলো। সব সরকারের শাসনামলেই উন্নতি ঘটেছে পুঁজিবাদী ধারায় এবং জননিষ্পেষণ ঘটেছে অদম্য নিষ্ঠুরতায়। সব শেষের সরকারটির কাজ চরমে পৌঁছেছিল। সে জন্যই বলছি, যুক্তফ্রন্ট গঠন প্রয়োজন বুর্জোয়া রাজনীতির বিরুদ্ধে। জামায়াতিদের পোশাকটাই যা ভিন্ন, নইলে তাদের সম্ভাব্য শাসন ফ্যাসিবাদী বুর্জোয়াদের মতোই জনবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে সমাজ বদলের যে স্বপ্ন ছিল, কোনো সরকারই তাকে আনুকূল্য দেয়নি; উল্টো নানাভাবে বিধ্বস্ত করার কাজে লিপ্ত থেকেছে। আজ তাই ঐক্য চাই সামাজিক মালিকানায় আস্থাশীল মানুষদের। এই ঐক্য হবে বিদ্যমান পুঁজিবাদী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। এর লক্ষ্য হবে সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুক্তি অর্জনের অভিমুখে অগ্রসর হওয়া।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়