ট্রাম্প-প্রত্যাবর্তনে যেসব পরিবর্তন

এম এইচ বরকত উল্লাহ

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

আজই (২০ জানুয়ারি) ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের মতো শপথগ্রহণ। এক টার্ম দায়িত্বের বাইরে থাকার পর। এই মাঝখানের সময়টাতে তাঁকে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পরাজয়ের পর প্রথমেই তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল ওঠে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের। বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা এ হামলা চালায় তাঁরই উসকানিতে। এ অভিযোগ মোকাবেলা করতে হয় তাঁকে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একজন পর্ণ তারকাকে মুখ বন্ধ রাখতে ঘুষ দেওয়ার মামলা হয় যা নিয়ে আলোড়ন ওঠে, তাঁকে কঠিন বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি আয়কর ফাঁকির মামলায়ও জড়িয়ে পড়েন। এসব নানাবিধ কারণে এবং তাঁর খোলামেলা, অপ্রচলিত বক্তব্যের জন্যও তাঁকে বহু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একসময় ট্রাম্পের নোমিনেশন পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে হয়েছিল। সবাইকে টপকে নোমিনেশন পাওয়ার পর তাঁর নির্বাচনি প্রচারণায় গুলির ঘটনা ঘটে। আহত হলেও তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প শুধু নির্বাচিতই হননি, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং কংগ্রেসেও তাঁর দল পেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন।

এখন একটি প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাঝখানে চার বছরে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো সত্য হোক বা অসত্য, যে বৈরিতা দু পক্ষের মধ্যে দেখা গেছে তা কি আজকের শপথ গ্রহণের পর তাঁকে আরো বেশি আগ্রাসী করে তুলতে পারে? সে ভয় কিন্তু অনেকের মনেই আছে। একটি বিশেষ ব্যাপার আমরা লক্ষ করেছি—এই নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে যে মাথাব্যথা, তার চেয়েও বেশি মাথাব্যথা ছিল বহির্বিশ্বে। কেউ কেউ তো বলছেন অনেকগুলো দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাগ্য সরাসরি নির্ভর করছে ট্রাম্পের গৃহীত পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। কথাটা একেবারে মিথ্যা না। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘২০ জানুয়ারির মধ্যে যদি হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি না দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে নরক নেমে আসবে। সত্যি বলছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’ লক্ষণীয় তিনি ‘মধ্যপ্রাচ্য’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, এর আওতায় থাকছে ইরান এবং ইরানের প্রক্সি ইরাক, ইয়েমেন, লেবাননসহ আরো কয়েকটি অঞ্চল।

এর বাইরে আরো কয়েকটি যুদ্ধ ও সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে আছে। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান ক্রাইসিস, সুদানের গৃহযুদ্ধ। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো রীতিমতো ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ব্যাপারে জনমত তৈরি হয়ে আছে। তবে একটা নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে যা অনেকের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর সেই বৈশিষ্ট্য হলো, বিদায়ি ডেমোক্র্যাট দল যেখানে ‘ইয়েস’ বলেছে, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘নো’ বলার সম্ভাবনা। কী অভিবাসন প্রশ্নে, কী ন্যাটো প্রশ্নে অথবা এশিয়া প্রশ্নে। তিনি যাঁদের তাঁর কেবিনেটে নিয়েছেন, তাঁদের সবারই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিল রয়েছে। ফলে ট্রাম্প কোন পথে হাঁটতে চাচ্ছেন তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর সেক্রেটারি অব স্টেট হতে চলেছেন মার্কো রুবিও। রুবিও বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সব অর্থে বড় হুমকি হচ্ছে চীন। তিনি ন্যাটো জোটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও ট্রাম্পের মতোই মনে করেন ন্যাটো জোটের অন্য সদস্যদের ন্যাটোর ব্যয়ভার বাড়ানো উচিত। কেন যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে অন্যদের নিরাপত্তা দেবে! এ নিয়ে ইউরোপীয় নেতারা একটা শঙ্কার মধ্যেই আছেন। কারণ ইউরোপের অনেকেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেছিলেন। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো পরোক্ষভাবে। মার্কো রুবিও ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পলিসিতে বিশ্বাস করেন। আর এই আমেরিকা ফার্স্ট ইউরোপকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সেক্রেটারি অব ডিফেন্স হিসাবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন পিটার ব্রায়ান হেগসেথকে, যিনি পিট হেগসেথ নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করেন, ইসলাম চলে গেছে ইসলামিস্টদের হাতে, যারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধ্বংস করতে চায়। হেগসেথ বিশ্বাস করেন, ২০২০ সালে নির্বাচনে ট্রাম্পের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসাবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন স্কট বেসেন্টকে। স্কট বিভিন্ন দেশের উপর ট্যারিফ আরোপের পক্ষপাতি। বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে পৃথিবীর সব দেশের জন্য বাজার উন্মুক্ত করেছে, সেখানে চীনের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর একমাত্র প্রতিকার হলো উচ্চ হারে ট্যারিফ নির্ধারণ করা। ট্রাম্প ন্যাশনাল সিকিউরিটি হিসাবে বেছে নিয়েছেন মাইকেল ওয়ালত্সকে। তিনি একজন চীন ও আফগানিস্তান এক্সপার্ট। তিনি বিশ্বাস করেন, আফগানিস্তানের মানুষকে শক্তি প্রয়োগ না করে ধীরে ধীরে কালচারালি পরিবর্তন সম্ভব।

ইউরোপের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোর অ্যামবাসাডর হিসাবে বেছে নিয়েছেন ম্যাথিউ জি. হোয়াইটেকারকে। হোয়াইটেকার বিশ্বাস করতেন—২০১৬ সালে এবং ২০১৮ সালে রাশিয়া ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য মার্কিন নির্বাচনে নাক গলিয়েছিল। তিনি এখন রাশিয়া তথা ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি যথেষ্ট নমনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োজিত ন্যাটোর অ্যামবাসাডর ইউরোপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুসারী।

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

শেয়ার করুন