চীনের ওপর শুল্ক আরোপে অনীহা ট্রাম্পের

মত ও পথ ডেস্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে দায়িত্ব নেওয়ার পরও এ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তবে গত বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভিন্ন সুর শোনা যায় ট্রাম্পের মুখে। সংবাদমাধ্যমটিকে তিনি বলেন, চীনের ওপর শুল্ক আরোপ না করাই ভালো। বরং বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘চীনের বিষয়ে আমাদের একটি বড় শক্তি আছে, সেটি হলো শুল্ক। এটি তারা চায় না। আর আমি চাই না, আমাকে এগুলো ব্যবহার করতে হোক। তবে এটি চীনের ওপর ব্যবহারের মতো একটি বিশাল শক্তি।’ অবশ্য চীনের ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত একেবারেই অমূলক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চীন আমেরিকা থেকে পাওয়া অর্থ তার সামরিক বাহিনীর পেছনে ব্যয় করছে।’

সাক্ষাৎকারে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক ফোনালাপের কথা তুলে ধরে তাঁর প্রশংসা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সি আমার বন্ধুর মতো। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ফোনালাপ হয়েছে। এটি একটি ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ ছিল। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ছাড়াও টিকটক ও তাইওয়ান ইস্যুর মতো বিষয়গুলোতে আলোচনা হয়েছে।’

চীনের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক উত্তর দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘চীন বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তাদের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন ব্যক্তি। কোভিডের আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক ছিল।’

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বহুদিন ধরে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ রয়েছে। প্রযুক্তি, সামরিক, বাণিজ্য—একে একে সব খাতে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। টিকটকের চীনা মালিক বাইটড্যান্সকে সরিয়ে অন্য কোনো মালিকানার অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা পরিচালনা করতে বলা হয়। সেটি সম্ভব না হওয়ায় টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাইডেন প্রশাসন। অবশ্য ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা ৭৫ দিনের জন্য মুলতবির নির্দেশ দিয়েছেন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বব্যাপী কম খরচে পণ্য তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত চীন। তারা এখন তাদের সেই পরিচিতিকে সেই উচ্চ প্রযুক্তির রপ্তানির মাধ্যমে পুনরায় অর্জনের চেষ্টা করছে। সৌর প্যানেল, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ চীন। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) অনুযায়ী, সৌর প্যানেল উৎপাদনে এখন অন্তত ৮০ শতাংশ অংশীদার চীন। দেশটি বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সেগুলোর ব্যাটারির সবচেয়ে বড় নির্মাতা।

আইইএর তথ্যমতে, গ্রিন এনার্জিতে চীনা বিনিয়োগ বিশ্বের মোট বিনিয়োগের এক-তৃতীয়াংশ। কারণ, দেশটি নবায়নযোগ্য শক্তিতে সক্ষমতা বাড়াতে অব্যাহতভাবে অসাধারণ অগ্রগতি দেখাচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড লুবিন বলেন, উচ্চ প্রযুক্তির ম্যানুফ্যাকচারিংকে সমর্থনের জন্য নিশ্চিতভাবেই চীনে একটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। এটি খুব সফল হয়েছে।

২০২৩ সালে বৈদ্যুতিক গাড়ি, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ও সৌর প্যানেলের রপ্তানি ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এক ট্রিলিয়ন ইয়ান বা ১৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো এই শিল্পগুলো চীনকে তার বৈশ্বিক আধিপত্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। এই রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে চীনা অর্থনীতিতে চলমান সম্পত্তি সংকটের আঘাত কিছুটা কমেছে। ন্যাটিক্সিস ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, চীনের অতিরিক্ত ক্ষমতা বাড়বে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের আর কোনো প্রবৃদ্ধির উৎস নেই।

ওই রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরোধও বেড়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; ইউরোপীয় ইউনিয়নও গত অক্টোবরে চীনে নির্মিত বৈদ্যুতিক গাড়িতে শুল্ক ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। মুডিস অ্যানালিটিকসের রিসার্চ ডিরেক্টর ক্যাটরিনা এল বলেন, এখনকার সমস্যা হলো পণ্যগুলোর বড় গ্রাহকেরা সেগুলো গ্রহণে ক্রমেই অনিচ্ছুক হয়ে উঠছে। এর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারও রয়েছে।

এমন বাস্তবতায় চীনে শুল্ক আরোপে ট্রাম্পের অনীহা নিঃসন্দেহে বেইজিংয়ের জন্য স্বস্তির। এদিকে বেইজিং যখন কিছুটা স্বস্তিতে, সেই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ নিয়ে দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার মেঘ ক্রমে ঘনিয়ে উঠেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দেখা যায়নি। সেখানে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সরাসরি মোদিকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। অথচ ভারতের মিডিয়া কয়েক বছর ধরেই নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত রসায়নের’ বয়ান তুলে ধরেছিল।

শেয়ার করুন