নতুন দল: ত্রাণের কম্বল ও সংগঠন চালানোর টাকা কোথায় পাচ্ছেন ছাত্ররা?

মত ও পথ ডেস্ক

ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে। এরই মধ্যে তাদের কেউ কেউ নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এলাকায় শীতবস্ত্রও বিতরণ করছেন, নিচ্ছেন নাগরিক সংবর্ধনা। এসবের আগে রাজধানীর বাংলামোটরে দুইটি অফিসও নিয়েছেন তারা। তাদের এই দল গঠনের প্রক্রিয়া, ফান্ডিং এবং সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় দল গঠন ইত্যাদি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। উঠেছে নানা প্রশ্ন। এ সংবাদ প্রকাশ করেছে ডয়চে ভেলে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তারা ৩২৮টি থানা কমিটি করেছেন। এরপর ওয়ার্ড কমিটির কাজও শুরু হয়েছে। সব থানা কমিটি করার পর জেলা কমিটি করা হবে।

তারপর জাতীয় কমিটি। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হবে। দলের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবেই থাকবে। যারা রাজনীতি করবেন, তারা এখান থেকে গিয়েই নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন।’

অরাজনৈতিক সংগঠন রাজনৈতিক দল গঠন করলে তারা অরাজনৈতিক থাকে কিভাবে— এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে যারা থাকবেন, তারা সরাসরি রাজনীতি করবেন না, তারা প্রেশার গ্রুপের কাজ করবেন। তাদের নতুন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তরুণরাই থাকবেন।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. জাহেদ-উর রহমান বলেন, ‘ছাত্রদের দুইটি সংগঠন-জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা বলছে— নতুন যে রাজনৈতিক দল হবে তারা এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে দল করবে। কিন্তু দল তৈরির কাজ তারাই করছে। ফলে তারা যে সরকারি প্রটোকল নিচ্ছে, এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তারা অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকার প্রাণকেন্দ্র এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল এলাকায় দুইটি অফিস নিয়েছে। তার খরচ নিয়েও প্রশ্ন আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার কথা, অন্য রাজনৈতিক দল কী করছে সেটা তাদের চিন্তায় নিলে হবে না। তাদের প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই জায়গা থেকে সরকারের সহায়তা না নিয়ে স্বাধীনভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে রাজনৈতিক দল গঠন করা উচিত।’

অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমানের বক্তব্যের জবাবে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি দাবি করেন, ‘যে তিনজন উপদেষ্টা ছাত্রদের মধ্য থেকে আছেন, তারা সরকারে আছেন। তারা এখন আর আমাদের সঙ্গে নাই। তারা রাজনীতি করছেন না। একমাত্র মাহফুজ আলম আমাদের পলিটিক্যাল দর্শন নিয়ে কাজ করেন। তাই তিনি মুজিববাদী এবং জামায়াতের দর্শনের জায়গা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।’

তিনি আরও দাবি করেন, ‘আমরা যারা সদস্য আছি, কমিটিতে আছি, তারাই এখন নিজেদের অর্থে সংগঠন চালাচ্ছি, অফিস ভাড়া দিচ্ছি। আর বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করা বা ত্রাণ দেওয়া বা কোনো সামাজিক কাজের জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করছি। তবে রাজনৈতিক দল হলে কীভাবে ফান্ড সংগ্রহ হবে তার নীতিমালা করা হবে। নীতিমালা না করে কোনো ফান্ড নেওয়া হবে না।’

নির্বাচনের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা দল গঠন করে আগে জনগণের কাছে যাব। তারা কী চায়, আমরা কী চাই সেটা নিয়ে কথা হবে, তারপর নির্বাচনের প্রশ্ন আসবে।’

তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘আমরা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করবো। আমি আমার এলাকায় এক হাজার কম্বল দিয়েছি। ওটা আমাকে এক ব্যবসায়ী দিয়েছেন। আর এলাকার মানুষ তোরণ বানিয়ে আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে তাদের ভালোবাসার কারণে।’

সারজিস আলমসহ আরও অনেকে এরই মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা দল গঠনের পর আমরা চিন্তা করব। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করেন, সেটা তাদের ব্যাপার।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘সমাজের নানা জায়গা এবং সামাজিক গণমাধ্যমে ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠেছে কিংস পার্টি গঠন হচ্ছে কি না। তরুণদের রাজনীতির আকাঙ্ক্ষার আমরা পক্ষে। আমরা সমর্থন করি। কিন্তু আমার কথা, তারা যদি সরকারের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান, তাহলে এটা জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না। এবং জনগণের সঙ্গে তাদের এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।’

‘শুধু তাই নয়, তাদের কথায়, বচনে আরো সংযত হওয়া প্রয়োজন। তাদের আরো বিনয়ী হওয়া দরকার। তারা সমাজের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন, পুশ করবেন- এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা সবাইকে বাদ দিয়ে সেটা করতে কি পারবেন? অন্যান্য রজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাদের এনগেজমেন্ট দরকার।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার তো অ-দলীয় সরকার। কিন্তু তারা যদি বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন, তাহলে তাদের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই। ফলে সরকার যদি ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনে সহায়তা করে, তারা বিতর্কিত হবে। আর ছাত্ররা যদি সহযোগিতা নিয়ে দল করে, তাহলে তাদের যে সম্ভাবনা আছে, তা হোঁচট খাবে।’

বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘অন্তর্র্বতী সরকারের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন, জামায়াতের আমিরও কয়েক দিন আগে একই কথা বলেছেন। তখন কিন্তু এই উপদেষ্টারা বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কোনো কথা বলেনি। চুপ ছিল। এখন কেন তারা তীব্র আক্রমণ করছে, এটা ভেবে দেখার দরকার আছে।’

এমরান সালেহ প্রিন্স মনে করেন, ‘সরকারের মধ্য থেকে, বিশেষ করে উপদেষ্টারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই। আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল গঠন করছে, তার সঙ্গে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা আছেন। সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের জন্য কাজ করছে। ফলে সরকার যেমন নিরপেক্ষতা হারাবে, তেমনি ছাত্রদের এই দলও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’

তার কথা, ‘তারা যে সরকারি সহায়তা নিচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে, ত্রাণ বিতরণ করছে, এসবের ফান্ডিং নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কি না তা সময়ই বলে দেবে।’

আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘বিএনপিই ক্ষমতায় থেকে দল তৈরি করেছে আমরা সেটা করছি না। বিএনপি মনে হয় তাদের অতীত ভুলে গেছে। এই সরকারে বিএনপির প্রস্তাবের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। আমার তো মনে হয় সরকার বিএনপির কথাই বেশি শুনছে। আমরা দাবি করার পরও রাষ্ট্রপতিকে সরানো হয়নি।’

আর নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘এই সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। বিএনপির সঙ্গে এই সরকারের কথা হয়, যোগাযোগ হয়। কোথাও সমস্যা থাকলে তারা সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারে। সেটা না করে বাইরে তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা তদবির নিয়ে বলতে পারে, বসতে পারে, সুবিধা নিয়ে বসতে পারে। ন্যাশনাল ইস্যু নিয়ে বসতে পারেন না কেন?’

তার কথা, ‘এই সরকারে যারা আছেন তাদের একটি অংশ প্রো-বিএনপি। অনেকেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের ফ্রেন্ড সার্কেলের। তাহলে এই সরকার আমাদের হয় কিভাবে?’

সূত্র: ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন