আট বছর পর ঢাবি-সাত কলেজ ‘বিচ্ছেদ’, শিক্ষা কার্যক্রমের কী হবে?

মত ও পথ ডেস্ক

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা রাজধানীর সরকারি ৭টি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। সেই হিসেবে প্রায় আট বছর ঢাবির অধীনে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম চলে সাত কলেজে। যে সংকটগুলো নিরসনে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি, পূরণ হয়নি লক্ষ্যও।

উল্টো জটিল হয়েছে সংকট। দূরত্ব বেড়েছে ঢাবি ও সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। সাত কলেজ যেমন ঢাবির অধীনে থাকতে চায়নি, তেমনি ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সাত কলেজকে ‘কাঁধের বোঝা’ হিসেবে সবসময় দেখে আসছে। শুধু ‘আর্থিক লাভের আশায়’ ঢাবি প্রশাসন সাত কলেজ ছাড়তে গড়িমসি করে এসেছিল।

অবশেষে আট বছর পর সেই সম্পর্কের ইতি টানলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঘটলো ঢাবি ও সাত কলেজের।

রোববার (২৬ জানুয়ারি) দিনগত রাতে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার সংঘর্ষের পর সোমবার (২৭ জানুয়ারি) জরুরি বৈঠকে অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে সেই সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।

উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ বলেন, আমরা আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল আগামী বছর অর্থাৎ, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি কার্যক্রম ঢাবি পরিচালনা করবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত এক বছর এগিয়ে এনেছি। চলতি (২০২৪-২৫) শিক্ষাবর্ষ থেকে সাত কলেজের ভর্তি ঢাবির অধীনে নেওয়া হবে না।

এদিকে, সাত কলেজ স্বতন্ত্র কাঠামো দিতে অন্তর্বর্তী সরকার যখন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেসময়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অধিভুক্তি বাতিলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে চলতি (২০২৪-২৫) শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাগুলো শেষ করা নিয়ে সমস্যা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান।

সাত কলেজে যেভাবে চলবে শিক্ষা কার্যক্রম

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়া আসন্ন। ঠিক সেই সময়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে কলেজগুলোতে ভর্তিপরীক্ষা হবে বা ভর্তি নেওয়া হবে।

ঢাবি উপাচার্যের সঙ্গে অধ্যক্ষদের যে জরুরি বৈঠক আজ হয়েছে, সেখানেও বিষয়টি মূল আলোচনায় ছিল। ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলবে, সে বিষয়টি ঢাবি কর্তৃপক্ষ সাত কলেজকে স্বতন্ত্র রূপ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে।

জরুরি সভায় সাত কলেজের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত এসেছে
ভর্তির প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে ঢাবি উপাচার্য বলেন, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, আসন সংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে থাকা অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। তার মধ্যেই তো এত বড় ঘটনা হয়ে গেলো। এখন ঢাবি অধিভুক্তি বাতিলের বিষয়টি জানিয়েছে। উপাচার্য যেটি বলেছেন বিশেষজ্ঞ কমিটি ভর্তির বিষয়টি সুরাহা করবে। আমার এখনো বিষয়টি নিয়ে কোনো ধারণা নেই। সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হয়তো একটা প্রক্রিয়া বের করা হবে। সেটা কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

বর্তমান শিক্ষার্থীদের কী হবে?

অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সাত কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। তার মধ্যেই হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিল করায় বর্তমানে অধ্যয়নরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রমগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন।

বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে। যাতে তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

একই সঙ্গে উপাচার্য বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, গত ২৯ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সভায় জোর সুপারিশ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত যত শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন, তাদের সার্বিক দিক দেখভাল করবে ঢাবি। তবে সেক্ষেত্রেও ঝামেলা এড়াতে মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষার্থীরা খুশি, শিক্ষকরা ধোঁয়াশায়

সাময়িক জটিলতা ও সংকট সৃষ্টি হলেও অধিভুক্তি বাতিলে খুশি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে কীভাবে, কোন প্রক্রিয়া বিষয়টি স্থায়ী সমাধান হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন শিক্ষকরা।

আব্দুর রাকিব নামে ঢাকা কলেজের তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ঢাবির অধিভুক্তির সময়ে কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সাত কলেজ আরও বেশি বিপাকে পড়েছিল। সেসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে এখানে শিফট করা হয়েছিল। তাতে সক্ষমতার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী হয়ে যায়। সেজন্য আমরা আসন সংখ্যা কমিয়ে মানসম্মত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির দাবি জানাচ্ছি।

সাত কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র কাঠামো হয়ে গেলে তখন বর্তমান শিক্ষার্থী ঢাবির অধীনে থাকতে চাইবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে তখন বর্তমান শিক্ষার্থীরা ঢাবির অধীনে থাকতে চাইবে কি না, তা এখনই বলা জটিল। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।

নাম প্রকাশ না করে সরকারি তিতুমীর কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, আমরা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে আমাদের পদমর্যাদা কেমন হবে, কীভাবে শিক্ষকদের সার্বিক দিক দেখা হবে সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। পাশাপাশি অধিভুক্ত শিক্ষার্থীরা ঢাবির অধীন বাকি শিক্ষাজীবন কাটাতে চাইবে কি না, তা নিয়েও ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে।

হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি সাত কলেজের কোনো অধ্যক্ষ। একটি কলেজের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করে বলেন, ভালো সমাধানের প্রত্যাশায় ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে সরকারের মধ্যস্থতায় স্বতন্ত্র কাঠামোতে যেতে চেয়েছিল আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যা হলো, তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাও কষ্টসাধ্য। আমরা এখনো বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে। সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছি।

হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিলে সংকট বাড়বে!

হঠাৎ অধিভুক্তি বাতিলে সংকট আরও বড় হলো বলে মনে করেন ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম ফায়েজ। তিনি বলেন, বড় একটা সংকট যে তৈরি হলো, তাতে সন্দেহ নেই। ভালো হতো যদি স্বাভাবিকভাবে সাত কলেজকে স্বতন্ত্র কাঠামোতে নেওয়ার যে চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটা নিয়মমাফিক হতো। আগামী বছর থেকে সেটা করার চেষ্টা করছিল সরকার। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অধিভুক্তি বাতিলের ঘটনায় সাত কলেজের ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়বে।

তিনি বলেন, আমি আশা করছি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে। শিক্ষার্থীরা কী চায়, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী, তাদের আগ্রহটা কোথায়, সেটা বুঝে যৌক্তিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। এক্ষেত্রে ইউজিসি সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন উপসচিব নাম প্রকাশ না করে বলেন, একটা প্রক্রিয়া তো আমরা শুরু করেছিলাম। সেটা নিয়ে তৎপরও ছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। তার মধ্যে এ ঘটনা। এখন করণীয় কী, তা ঠিক করা জটিল হবে। শিগগির বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে ভর্তি ও পড়াশোনা কীভাবে চলবে, সেটা কারা পরিচালনা করবে, কীভাবে করবে, বিষয়টি স্পষ্ট করা হবে।

শেয়ার করুন