একুশে বইমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনীর স্টলে তসলিমা নাসরিনের লেখা বই থাকায় স্টল ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আটক হয়েছেন সব্যসাচী প্রকাশনীর সহ-প্রকাশক শতাব্দী ভব। ভাঙচুরের পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলে শতাব্দী ভবকে বইমেলা থেকে বের করে দিয়েছে উগ্রবাদীরা। পাশাপাশি স্টলটি সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।
আজ সোমবার (১০ই ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ভাঙচুরের পর সব্যসাচী প্রকাশনীর প্রকাশক ও অভিনেত্রী মেহেরান সানজানা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, স্টল ভাঙচুর হচ্ছে। ভবকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রেখেছে।
স্টলের বিক্রয়কর্মীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদল উগ্রবাদী স্টলে তসলিমা নাসরিনের বই দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এসময় তারা স্টলের লোকজনের কাছে জানতে চান কেন তসলিমার বই রাখা হয়েছে। তারা এসময় অশালীন ভাষায় গালাগালও করেন স্টলের লোকজনকে। এসময় তাদের আচরণের প্রতিবাদ করেন লেখক ও সব্যসাচী প্রকাশনীর সহ-প্রকাশক শতাব্দী ভব। তিনি তাদেরকে সরে যেতে বললে উগ্রবাদীরা তার ওপর চড়াও হন।
তখন শতাব্দী ভব তাদের কাছে জানতে চান, কেন তারা জঙ্গিদের মত আচরণ করছে, তারা কেন নিজেদের পছন্দের বইয়ের স্টলে চলে যাচ্ছেনা। এ কথা নিয়ে দুইপক্ষে বাগবিতন্ডা শুরু হলে একপর্যায়ে শতাব্দী ভবকে মারধর শুরু করে উগ্রবাদীরা। তখন তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন বলে দাবি করেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী। যার জেরে ভবকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে স্টলে ভাঙচুর করে উগ্রবাদীরা।
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ এগিয়ে আসে এবং উগ্রবাদীদের দাবির মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয় লেখক শতাব্দী ভবকে। পরে পুলিশ তাকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায়।
বইমেলা টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক ড. সেলিম রেজা বলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে সব্যসাচী স্টলটি বন্ধ করা হবে কিনা সে ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে এ ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত।
মেহেরান সানজানা জানান, প্রতি বছরই তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ করেন তিনি। বাংলাদেশ বইমেলায় ফি-বছর সেই বই বিক্রিও হয়। দেশে তসলিমার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় অল্পবিস্তর হুমকিও পেতে হয়। কিন্তু কোনদিন তা মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। তাই তিনি এ নিয়ে মাথা ঘামাননি কখনও। কিন্তু এ বছর একটু বেশিই ভয় পাচ্ছেন।
সানজানা আরও জানান, এ বছরও তিনি প্রকাশ করেছেন তসলিমার ‘চুম্বন’ বইটি। তারপর থেকেই একের পর এক হুমকিবার্তা আসছে তার কাছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক বার্তায় তার দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি।
গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল তাকে।
সানজানার অভিযোগ, প্রতি বছর এক মাস ধরে এই মেলা চলে। আমরা সবাই খুব আনন্দ নিয়েই যাই বইমেলায়। কিন্তু এ বছর বেশির ভাগ ক্রেতাই মেলা বয়কট করেছেন। তাদের দাবি, এবারের বইমেলা যেন জঙ্গিদের! আমার মনে হয় না, তারা খুব ভুল ভাবছেন।
কিন্তু কী এমন ঘটেছে? সানজানা গত দু’দিনে বার বার তার ফেসবুকে উল্লেখ করেছেন, তার স্টল থেকে তসলিমার বই সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।
তার অভিযোগ, দেশজুড়ে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। হুমকির পর হুমকি আসছে!
আপনি ভয় পাচ্ছেন কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি অকপটে জানিয়েছেন, ভয় পাচ্ছেন। তার ভাষ্যে, ‘আমি নারী, আমার সংসার-সন্তান রয়েছে।’
সানজানার আশঙ্কা, সাহসী হয়ে বই বিক্রি করতে গিয়ে তাকে হয়তো বইমেলাতেই আক্রান্ত হতে হবে। অবশ্য সে কারণে আপসের পথে হাঁটবেন না। কারণ সানজানা বিশ্বাস রাখেন দেশের মানুষের ওপর।
তিনি বলেন, শুক্রবার তসলিমার দ্বিতীয় বই ‘ছেঁড়া পাতা’ প্রকাশ করতে চলেছি। মুক্তমনাদের কথা না পড়লে মানুষের মন মুক্ত হবে কী করে?
তবে, নিজের দেশের বইমেলার চেহারা বেশ খানিকটা বদলেছে বলে দুঃখপ্রকাশ করেছেন তিনি।
তার আফসোস, এ বছর মননশীল পাঠকেরা অনেকেই আসেননি। তারা মনে করছেন বইমেলার চরিত্র বদলে গিয়েছে। তারা পছন্দের স্টলের বদলে অপছন্দের স্টল-প্রকাশনীই দেখছেন বেশি।