চোখের বদলে চোখ

চিররঞ্জন সরকার

চিররঞ্জন সরকার
চিররঞ্জন সরকার। সংগৃহীত ছবি

‘ইটের বদলে পাটকেল/আর চোখের বদলে চোখ/পৃথিবীটা অন্ধ হয়তো হোক’—এই মন্ত্রেই যেন এখন সবাই চলছে। চারদিকে কেবল হিংসা আর হিংসা। চারদিকে সম্মিলিত কণ্ঠে অবিরত ঘোষণা আসছে—‘ওকে ঘৃণা জানাও’, ‘ওর গায়ে থুতু দাও’, ‘ওকে স্তব্ধ কর’, ‘ওকে দেশান্তরী কর’, ‘ওকে বিনাশ কর’। মানুষ এখন হিংসা ছাড়া যেন আর কিছুই চিন্তা করতে পারে না। মানুষই বোধ হয় একমাত্র প্রাণী, যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্যতার বাইরেও জারি রাখে অন্য এক লড়াই। সে লড়াই হিংসার চাবুক হাতে, নিরতিশয় লোভ, ক্ষমতা, আধিপত্য ও আগ্রাসনের পিঠে চড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয় হিংসার বীজ। অযুত সংঘর্ষের জন্ম দেয়। অথচ আমরা সবাই জানি যে, হিংসা একটি দুষ্টচক্রের মতো, একটি ভাইরাসের মতো। হিংসা শত্রুর অন্তরে কেবলই বুনে চলে নিজের বীজ। হিংসা দিয়ে কেউ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না, শত্রুকে সঙ্গে নিয়ে কেবলই ঘুরতে থাকে শত্রুর বৃত্তে এবং পরিণামে নিজেকে ধ্বংস করে। লাভের লাভ হয়তো কেবল এটুকুই হয় যে, নিজের লাশটা স্থান পায় শত্রুর লাশের ওপর। আমরা যদি এভাবে চোখের বদলে চোখ নিতে থাকি, তাহলে পৃথিবীর সৌন্দর্য থাকবে ঠিকই, কিন্তু সেই সৌন্দর্য দেখার মতো কোনো চোখ অবশিষ্ট থাকবে না!

অথচ আমাদের এই ভারতবর্ষের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধী সমাজে অহিংসার বাণী প্রচার করে গেছেন। তিনি ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করার পরামর্শ দিয়েছেন। গান্ধীজির মত মানলে, কেউ যদি ডান গালে চড় মারে তাহলে বাম গাল পেতে দেবে। এর ফলে একসময় তার ক্রোধ কমে আসবে। সে আর মারমুখী হবে না। পক্ষান্তরে কেউ যদি মারের বদলে মার দিতে চায়, তাহলে মারামারি চলতেই থাকবে। উভয়ের মধ্যে হিংসা সঞ্চারিত হবে। এই হিংসা প্রতিশোধস্পৃহা বাড়িয়ে দেবে। মারামারি-খুনোখুনির মাধ্যমে এর পরিণতি নির্ধারণ হবে। তবে তাতেও মারামারি-খুনোখুনি শেষ হবে না। যে মার খাবে, পরাজিত হবে, সে আবার শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এটা চলতেই থাকবে।

রক্তপাত, হিংসা, হানাহানির কারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে গান্ধীজি খুব একটা পছন্দ করেননি। কারণ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিপ্লব করতে হয়। বিপ্লবে রক্তপাতের প্রয়োজন হয়। শ্রেণিশত্রু ‘খতম’ করে মেহনতি মানুষের শাসন কায়েম করতে হয়। এখানেই গান্ধীজির প্রবল আপত্তি। তিনি বিপ্লব, রক্তপাত, খুন, খতম—এসব ভীষণ অপছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

হিংসা কেবলই হিংসার জন্ম দেয়। পুঁজিপতি বা বড়লোক বা শোষকদের প্রতি হিংসাপ্রবণ হয়ে মেহনতি মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা কখনো সফল হতে পারে না। কারণ, বড়লোকেরাও সমাজেরই মানুষ। তাদের খতম করার অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে স্থায়ী হিংসার বীজ বপন করা হয়। বড়লোকের আত্মীয়স্বজন, বংশধররা প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে থাকে। সুযোগ পেলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে সমাজে হানাহানি-মারামারি ক্রনিক চলতেই থাকে। এর বদলে গান্ধীজি চেয়েছেন অহিংস নীতি প্রতিষ্ঠা করতে। অহিংসা এবং পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সাম্যের সমাজ গড়তে!

গান্ধীজি ভারতবর্ষসহ দুনিয়াজুড়ে পূজনীয় হলেও তার মতো তেমন কেউ গ্রহণ করেনি। সারা জীবন অহিংসার বাণী প্রচার করলেও তিনি নিজে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। অর্থাৎ হিংসার বলি হয়েছেন! আসলে দুনিয়ার মানুষগুলো বড়ই বিচিত্র। কে যে কার বাণী গ্রহণ করবেন, আর কী আচরণ করবেন, তা আগেভাগে ঠাহর করা যায় না। তবে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ গান্ধীজির মতের বিপরীতটাকেই পছন্দ করেছেন বেশি। অহিংসা নয়, হিংসাকেই বেছে নিয়েছেন জীবনের আদর্শ হিসেবে। প্রেম-ভালোবাসা নয়, হিংসা, হানাহানি-মারামারি, গালাগাল প্রতিশোধ—এগুলোই হচ্ছে এখন মানবজাতির একমাত্র সাধনা!

একজন যদি একটা গালি দেয়, অপরজন কমপক্ষে তিনটে গালি দিয়ে তার প্রতিশোধ নিতে চায়। কাউকে আপনি থাপ্পড় দিলে সে কয়েক ঘা থাপ্পড় কিল-ঘুষিসহ ফিরিয়ে দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা করে। আমরা সবাই যেন গোলের খেলায় মেতেছি। গোল হলে যেকোনো মূল্যে তা পরিশোধ করতে হবে। এক গোল খেলে পাঁচ গোল দিয়ে প্রতিশোধ নিতে হবে। কিন্তু ইটের জবাব সব সময় পাটকেলে দিতে নেই, উপেক্ষা করতেও জানতে হয়। উপেক্ষা করতে না জানলে দীর্ঘদিন নিরুদ্বেগে কাটানো যায় না। কেবলই খেয়োখেয়ি মারামারি করে কতক্ষণ আর টিকে থাকা যায়?

ব্রিটিশরা কিন্তু অনেক কিছু উপেক্ষা করে থাকতে পারত। তাতে করে ২০০ বছর শান্তিতে শাসন করে গেছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমাদের শাসকদের সব থেকে বড় সমস্যা হলো, তাদের অভিধানে ‘উপেক্ষা’ শব্দটি একেবারেই নেই। আর এরই ফায়দা নিচ্ছে সুচতুর ষড়যন্ত্রকারী শক্তি।

আমাদের দেশে যারা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ভয়ানক প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। তারা কেবলই শিক্ষা দিতে চায়। কেউ যদি সামান্য মুখ ভেংচি কাটে, অমনি তারা ইটপাটকেল হাতে তেড়ে যায়। এই ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতি কখনো কখনো খুব কার্যকরী হয়; কিন্তু কখনো কখনো অকারণ বিপত্তিও ডেকে আনে।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অপরিণামদর্শী আচরণ দিয়ে এমন সব ব্যক্তি ও দলকে খুঁচিয়ে-খেপিয়ে প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে যে, তারা পরবর্তীকালে রীতিমতো একটা পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক নীতি অবলম্বনের ফলে আদতে যেটা হয় তা হলো, যে ব্যক্তি বা দলকে গতকাল দেশের কেউ চিনত না, কেউ নামও জানত না, সে আজ খুব অল্পেই পেয়ে যাচ্ছে অপ্রাপ্য ফুটেজ। উপেক্ষা করলে যে ইঁদুর হয়ে থাকত, ঝগড়া-তর্ক করে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে তাকেই দেওয়া হচ্ছে বাঘের মর্যাদা।

তুমি এক গোল দিলে আমি দেব পাল্টা আর এক গোল—মুশকিল হলো, এই খেলাটার কোনো শেষ নেই। এতে করে বরং প্রতিপক্ষরা নিজের লাইন অব অ্যাকশন ঠিক করে নেয়। তারাও ইটের বদলে মুগুর নিয়ে তেড়ে আসে। আমাদের দেশে বুঝে না বুঝে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে সুকৌশলে খেপিয়ে তুলছে। এই খেলায় প্রতিপক্ষ যেমন দৌড়ের ওপরে থাকছে, অন্য পক্ষও পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে, বাঁদরনাচ নাচছে! তাদের কে বোঝাবে সব সময় কথার হুল ফুটিয়ে, মেরে-কেটেই কেবল নয়, উপেক্ষার মাধ্যমেও উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়!

প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী দুনিয়াটা চলে একটা ভারসাম্যের নিয়ম মেনে। এটা বোঝার মতো জ্ঞান হয়তো সবারই আছে। কিন্তু অনেকেই তা ভুলে যায়। আমাদের দেশের দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সেই গানের চরণ—‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়’—এটাকে আমরা কেউ স্মরণে রাখি না!

প্রতিশোধের পেছনে সব শক্তি ব্যয় করলে নতুন কিছু করার, নতুন করে গড়ার শক্তি থাকে না। দেশকে যদি ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেওয়া যায়, সৃজনশীল উদ্যোগ দিয়ে উন্নয়নের বিস্ময় সৃষ্টি করা যায়, সেটাই হবে সেরা প্রতিশোধ। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি কোনো সুফল ফলায় না। হানাহানির রাজনীতি পরিহার করে দেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটুক দেশবাসী তা-ই চায়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করতে এবং জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক ও পরিচালকদের মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতার পরিবর্তন হলেই কেবল আচরণ বদলাবে এবং আচরণ বদলালেই রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতাভিত্তিক সংস্কৃতি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হবে, ঘৃণাবোধের অবসান ঘটবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ঘৃণাবোধের পরিণতি ভয়ংকর হতে বাধ্য। শুধু ইটের বদলে পাটকেল, মারের বদল মার, চোখের বদলা চোখ হলে হানাহানিই কেবল চলতে থাকবে। মহাত্মা গান্ধীর কথাটা আমাদের মনে রাখা উচিত যে, চোখের বদলে চোখ নিলে সারা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়। আমরা নিশ্চয়ই কেউ অন্ধের সমাজ চাই না!

লেখক : কলামিস্ট

শেয়ার করুন