একুশ মানে মাথা নত না করা

সম্পাদকীয়

ফাইল ছবি

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। মহান শহীদ দিবস। একইসঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই আন্দোলন গড়ে উঠলেও এ ছিল গণতন্ত্র ও ন্যায়ের সংগ্রামের পথে যাত্রার অঙ্গীকার। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের আমলানির্ভর সরকার ও প্রশাসনের চাপিয়ে দেওয়া একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল বাংলার জনগণ। বাঙালির চাওয়া ছিল গণতান্ত্রিক। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার অধিকারী হয়েও বাংলার নেতৃত্ব সেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করেছিল, একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নয়। কিন্তু সেই দাবিও মানতে চায়নি সরকার। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন রফিক, বরকত, জব্বার। গুরুতর আহত সালাম মারা গিয়েছিলেন ৭ এপ্রিল। ২২ ফেব্রুয়ারিও মিছিলে চলেছিল গুলি। ঝরে গিয়েছিল শফিউর রহমানসহ আরও কয়েকটি তাজা প্রাণ।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানি শাসকরা ঘোষণা করেছিল ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। প্রতিবাদী তরুণরা সেদিন তাদের মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল, ‘না’। তার পরই স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলার আনাচকানাচে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা তুঙ্গে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি বন্দুকের নল অগ্রাহ্য করে মিছিল এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। কিন্তু শাসকের বুলেট আন্দোলন থামাতে পারেনি। অবশেষে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা পেয়েছিল স্বীকৃতি।

মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর সেই বিরল আত্মদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই শহীদদের, যাঁরা রাজপথে ভাষার জন্য তাঁদের জীবন দিয়ে গেছেন। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এমন এক গর্বিত অহংকারের উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা এখনও আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করতে পারিনি। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা এখনও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিচ্ছি। এই অবস্থা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসা উচিত।

দুঃখের বিষয়, শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপারে সোচ্চার হয় সরকার, মিডিয়া ইত্যাদি। উচ্চশিক্ষা কিংবা উচ্চ আদালতে বাংলার যেটুকু প্রচলন আছে, তা গর্ব করার মতো নয়। বাঙালি ছাড়াও আমাদের ভূখণ্ডে বিভিন্ন ভাষাভাষী যেসব মানুষ আছে, তাদের ভাষার অধিকার সংরক্ষণের জন্য খুব বেশি কাজ হয়নি। বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু নিজ ভাষায় পোক্ত না হয়ে শুধু ইংরেজির দিকে ঝোঁক থাকলে তা দেশের মর্যাদা বাড়ায় না। ভাবনার এই অঞ্চলকে কীভাবে একটি নির্দিষ্ট রূপ দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবা দরকার। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ভাষা-পরিকল্পনা।

আমরা মনে করি, বৈশ্বিক প্রয়োজনে আমাদের ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষাও শিখতে হবে। একই সঙ্গে মাতৃভাষার চর্চাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি আমরা; কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, সেগুলোর কি নিষ্পত্তি করতে পেরেছি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য; কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরে? দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে শহীদদের স্মরণ করা হয় কি? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্তোষজনক নয়। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একুশের কাছ থেকেই পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’।

শেয়ার করুন