এ বছরও গরমে পুড়বে দেশ

মত ও পথ ডেস্ক

প্রতীকী ছবি

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৪ সাল। গত এপ্রিলে তাপমাত্রা ছিল ৭৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে টানা ৩৫ দিন তাপপ্রবাহ চলে। এবারও তাপমাত্রার চোখরাঙানি দেখছেন আবহাওয়াবিদরা। এপ্রিল ও মে মাসে মেঘ সৃষ্টির প্রবণতা কিছুটা বেশি থাকতে পারে। কালবৈশাখীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। আর তাতে গত বছর যেভাবে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলেছে, তা নাও থাকতে পারে। তবে গরমের অনুভূতি আগের চেয়ে বেশি হতে পারে।

আবহাওয়াবিদদের ধারণা যে অমূলক নয়, পুরো শীতকালেই খানিকটা আঁচ পাওয়া গেছে। এবার শীত তেমন অনুভূত হয়নি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আর ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা বেশি ছিল ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে গেছে। এই শীতে একটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহও দেখা যায়নি। শীতে বৃষ্টিও হয়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ কম।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ইতোমধ্যে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলেছে, মার্চে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। এ মাসের শেষ দিকে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এপ্রিলজুড়ে থাকবে তাপপ্রবাহ।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, শনিবারের পর থেকেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করতে পারে এবং তা অব্যাহত থাকবে। শীতের মাসগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা এবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, গরম অনেকটাই বেশি পড়বে।

বিশ্বজুড়ে পরিবর্তিত জলবায়ু এরই মধ্যে ভয়ানক পরিণতি ডেকে এনেছে। গত বছর এপ্রিলজুড়ে খরতাপ একে একে ভেঙেছে অতীতের অনেক রেকর্ড। এক মাসের প্রবল গরমে জীবন ও সম্পদের বড় ক্ষতি হয়েছে। নিভে গেছে শতাধিক প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়ে কৃষি, নেমেছে পানির স্তর। বেঁকে গেছে রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো সড়ক। দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম বলেছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব এখন মোকাবিলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে দেশে। বর্ষা আসার সময় পাল্টেছে। চলে যেতেও বিলম্ব হচ্ছে। শুধু বর্ষা নয়, শীত বা গ্রীষ্মেও বেড়ে যাচ্ছে তাপ। মেঘাচ্ছন্ন দিনের পরিমাণ বাড়ছে। তাতে শীতের দিন তাপ বাড়লেও শীতের তীব্রতার অনুভূতি হচ্ছে বেশি মাত্রায়। এর সঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৪০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রার ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী– তিন সময়েই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৯, শূন্য দশমিক ৩৩ এবং শূন্য দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শুধু শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে গেছে শূন্য দশমিক ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে চার কালেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে। বর্ষাকালে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে ঢাকাসহ আট বিভাগেই।

আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ বলেন, রাজশাহীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাপপ্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ভবিষ্যতে বৃষ্টির সময়ও কমে আসতে পারে। হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃষ্টি হতে পারে। এমন বৈরী পরিস্থিতি কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জন্য শঙ্কার বিষয়।

বৈশ্বিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব আছে। এগুলো হলো প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর বাতাসের ধরন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। এল নিনো বলতে বায়ুপ্রবাহের উষ্ণ পর্যায়কে বোঝায়। অন্যদিকে লা নিনা বোঝায় এর শীতল পর্যায়কে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছিল।

এর আগে মহাসাগরের উপরিতলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল, যা আবহাওয়াবিদদের ভাষায় ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি হিসেবে পরিচিত।

তবে চলতি বছরে লা নিনা প্রাধান্যশীল বলে ধরা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, গরম তত তীব্র নাও হতে পারে। কিন্তু আবহাওয়ার বিভিন্ন মডেল ব্যাখ্যা করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, লা নিনার প্রভাব অনেকটাই কমে আসছে।

যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিসের ওয়েবসাইটে দেওয়া পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫ সাল বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রার নিরিখে উষ্ণতম বছরের মধ্যে একটি হতে পারে। ২০২৪ এবং ২০২৩ সালের ঠিক পরেই থাকবে।

লা নিনার কারণে গরম যে খুব কমে যাবে, তা বলছে না জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল বা আইপিসিসি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লা নিনার শীতল প্রভাব সত্ত্বেও চরম তাপ এখনও উদ্বেগের বিষয়।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার লা নিনার বছর হলেও, গত বছরের চেয়ে তাপমাত্রা এবার অনেকটা কমে যাবে– এমন সম্ভাবনা কম। গত বছরের উষ্ণ আবহাওয়ার ধারাবাহিকতা এবারও থাকতে পারে। এর জন্য যে শুধু বৈশ্বিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতিই কারণ, তা-ই নয়। গাছ উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ পরিবেশ বিরুদ্ধ নানা কর্মকাণ্ডের ভূমিকা আছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, গরমকালে তাপপ্রবাহ প্রশমনে বড় ভূমিকা রাখে কালবৈশাখীর ফলে সৃষ্ট ঝড় ও বৃষ্টি। এবার মার্চ ও এপ্রিলে দেশে বৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় থাকতে পারে। তবে তাতে গরম কমবে না। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। আর সেই সঙ্গে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, বন বিনাশ, গাছ ধ্বংসের মতো কারণগুলো রয়েছে। তাই তাপমাত্রা যাই থাকুক, গরমের অনুভূতি আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকতে পারে। সেই অনুভূতি এবারও যথেষ্ট থাকার আশঙ্কা আছে।

শেয়ার করুন