গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ছয় সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তবে এটি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতি বলার চেয়ে বরং ‘অগ্নিকাণ্ড হ্রাস করা’ বলা বেশি যথাযথ হবে। এখনো বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, যা যেকোনো পরিস্থিতিতেই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্রের মতে, ১৯ জানুয়ারির পর থেকে ১০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য লঙ্ঘন মিলিয়ে ইসরায়েলি সরকার যুদ্ধবিরতির শত শত শর্ত লঙ্ঘনের এক মর্মান্তিক রেকর্ড গড়েছে।
সবশেষ যে ঘটনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হয়েছে, তা হলো গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করার ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত। তারা হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে তারা নতুন যুদ্ধবিরতি শর্ত গ্রহণ করে। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গাজায় সব রকমের সহায়তা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েল খাদ্য ও বেসামরিক ত্রাণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যা তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যারা গত কয়েক মাসে বন্দী মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে, এটিকে যুদ্ধবিরতির শর্ত এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে।
এটি এমন একটি অবরোধ, যা কেবল কিছু ফিলিস্তিনির ওপর প্রভাব ফেলবে না; বরং গাজার প্রতিটি মানুষই এর শিকার হবে। পুরো জনসংখ্যাকে কার্যত বন্দী করে রাখা হয়েছে। গাজার ফিলিস্তিনি এনজিও নেটওয়ার্কের পরিচালক আমজাদ আল-শাওয়া বলেন, গাজার সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী এখন সম্পূর্ণভাবে সহায়তার ওপর নির্ভরশীল, কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতি মৃত্যুর, অনাহারের এবং পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে অবরুদ্ধ করে রাখার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, যাদের শিশুরা এখনো ছিন্নভিন্ন তাঁবুর শীতলতায় প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মারা যাচ্ছে, তাদের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে।
পশ্চিম তীরে ধীরে ধীরে কিন্তু মাসের পর মাস ধরে অবিরাম হামলা হয়েই চলেছে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তা আরও তীব্র হয়েছে। গাজায় অভিযান শিথিল হওয়ায় ইসরায়েল পশ্চিম তীরের দিকে মনোযোগ দিতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলি নাগরিকদের সহিংসতা ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর আক্রমণে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ হাজারে পৌঁছেছে। যুদ্ধবিরতি এই পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করে তুলেছে। গাজায় ইসরায়েলের সক্রিয় সামরিক উপস্থিতি কিছুটা কমায়, তারা পশ্চিম তীরের দখলকৃত ভূখণ্ডের দিকে তাদের মনোযোগ দিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই ‘গাজাকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
গাজায় যে যুদ্ধ চলছে এবং সেখানে যে হারে বেসামরিক হত্যা, গণ-উচ্ছেদ ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়েছে, তা যেন এক পরীক্ষিত মডেলে পরিণত হয়েছে, যা এখন পশ্চিম তীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ইসরায়েল নিশ্চিত যে তার পশ্চিমা মিত্ররা সমর্থন অব্যাহত রাখবে এবং অস্ত্র ও রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে। এই নিশ্চয়তার ওপর ভর করে ইসরায়েলি সরকার এখন ফিলিস্তিনের অন্যান্য জায়গায়ও একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি করছে।
যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহূর্তেই ইসরায়েল ‘অপারেশন আয়রন ওয়াল’ নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে পশ্চিম তীরে, যেন এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই যুদ্ধ এখন চিরস্থায়ী প্রতিশোধের রূপ নিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত এক বছরেই পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে ২২৪-এর বেশি শিশু নিহত হয়েছে। ২০ বছর আগে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে নিহত মোট শিশুর সংখ্যার প্রায় অর্ধেক এই সংখ্যা।
এদের মধ্যে একজন হলো আয়মান আল-হাম্মুনি, যাকে গুলি করার দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডজুড়ে শিশুদের শেষ মুহূর্তের আতঙ্ক ও মৃত্যু ধরা পড়েছে। রয়েছে দুই বছরের শিশু লায়লা আল-খতিব, যাকে তার নিজের ঘরেই গুলি করা হয়েছে। আর রয়েছেন সুন্দোস জামাল মোহাম্মদ শালাবি, যিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন—গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ও তাঁর অনাগত সন্তান একসঙ্গে মারা যান। এভাবেই চলছে—নিরবচ্ছিন্ন, অকল্পনীয়, অবিরাম।
যে কৌশল ও যৌক্তিকতা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা গাজার সঙ্গে আশঙ্কাজনকভাবে মিল রয়েছে। ‘জঙ্গিদের টার্গেট করা’—এই ব্যাখ্যার আড়ালে চালানো হচ্ছে একের পর এক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম, যার মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো ধ্বংস করা, মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা (যাদের ফিরে আসার কোনো অধিকার নেই)—জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর মতে, মাত্র দুই মাসের কম সময়ে ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, চিকিৎসাকেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে, আবাসিক এলাকাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এবং সবচেয়ে প্রাণঘাতী নীতি—সেনাদের জন্য যুদ্ধের নিয়ম শিথিল করা, যাতে তাঁদের আরও বেশি স্বাধীনতা ও নির্বিচারে গুলি চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়।
ইউএনআরডব্লিউএর মতে, ‘ইসরায়েলি বাহিনী এখন পশ্চিম তীরে নিয়মিতভাবে বিমান হামলা, সাঁজোয়া বুলডোজার, দূর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরক এবং উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করছে’, যা গাজার যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব। এর ফলাফল হলো পশ্চিম তীরে এমন হামলা চালানো, যা ইতিহাসে যেমন নজিরবিহীন, তেমনই গাজার মতোই ধ্বংসাত্মক ও নিষ্ঠুর।
অপারেশন আয়রন ওয়াল দ্বিতীয় ইনতিফাদার পর পশ্চিম তীরে সবচেয়ে দীর্ঘতম অভিযান। ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ট্যাংক নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ) পশ্চিম তীরের শরণার্থী শিবিরগুলোতে, বিশেষ করে জেনিন ও তুলকারেমের মতো এলাকায়, দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের জন্য ঘাঁটি গেড়েছে। এই পদক্ষেপগুলো ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়—গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের আচরণ এখন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা, অবরোধ, আইনগত নিপীড়ন এবং বিচারবহির্ভূত আটক—এই ধরনের ‘নির্যাতনমূলক ক্ষয়যুদ্ধ’-এর কৌশল থেকে এখন তারা আরও ভয়ংকর ও দমনমূলক শাসনের দিকে এগিয়ে গেছে, যার পেছনে কোনো সুস্পষ্ট কৌশলগত উদ্দেশ্য বা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার পরিকল্পনা নেই।
মূল লক্ষ্য মনে হচ্ছে—ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ, সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে একটি ‘সংকীর্ণ ঘেরাটোপে বন্দী করে রাখা’ এবং তাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এমনকি কখন তারা খাবে, আর আদৌ তারা বাঁচার অধিকার রাখে কি না—সেটাও নির্ধারণ করতে চায় ইসরায়েল। এর ফলাফল হচ্ছে—ফিলিস্তিনিদের যা সামান্য কিছু অবশিষ্ট ছিল, তা আরও কমে আসা: আরও কম ভূমি, আরও কম স্বায়ত্তশাসন এবং আরও কম মানবাধিকার।
গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ একটি অবহেলার মনোভাব প্রদর্শন করে, যা আলোচনার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। যদি গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে পড়ে, তবে আবার সংঘাত হবে। তাতে বেশি ক্ষতি হবে ফিলিস্তিনিদেরই।
যুদ্ধবিরতির এই রক্তাক্ত ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেখে কারও বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয় যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে, অথবা যুদ্ধের পরে স্থিতিশীল ভবিষ্যতের কোনো প্রতিশ্রুতি আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প, আরব নেতারা এবং ইসরায়েলি সরকার সেরা ‘গাজা পরিকল্পনা’ কী তা নিয়ে যত খুশি আলোচনা করতে পারে। বাস্তবতা হলো, গাজার যুদ্ধ আপাতত শেষ হতে পারে; কিন্তু ফিলিস্তিন ভূখণ্ডজুড়ে শুরু হয়েছে। আসলে ‘যুদ্ধবিরতি’ ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি ফাঁপা শব্দ। কেননা হত্যা, বাস্তুচ্যুতি এবং সহায়তা প্রত্যাখ্যান অব্যাহত রয়েছে।
(দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে)