গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে টানা কয়েক মাস নানা দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন কর্মসূচি ঘিরে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এসময় দফায় দফায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতি দেখা গেছে। মাঠে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় রাজধানীর অলি-গলিতে ডাকাতি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে অনেক। যার রেশ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এমন প্রেক্ষাপটে এবার উদযাপিত হতে হচ্ছে ঈদুল ফিতর। ফলে নিজেদের নিরাপদ রাখতে বাড়তি সতর্ক থাকতে হচ্ছে নগরবাসীদের। নিরাপত্তা শঙ্কায় ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে না গিয়ে ঢাকায় ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে।
আবার ঈদ ঘিরে অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। এতে বাসাবাড়ি, ফ্ল্যাট ও অফিস ফাঁকা হয়ে যাবে। ফাঁকা ঢাকায় অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে নগরবাসী। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি— এই তিন আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছে অনেককে। এসব বিষয় মাথায় রেখে ঈদের আগে ও পরে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সংস্থাটি জানায়, ঈদ ঘিরে রাজধানীতে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা থাকবে। থানা-পুলিশের বাইরে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) পুলিশ দল, পুলিশের বিশেষায়িত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মিলিয়ে মোট ১৫ হাজার পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।
এবার ঈদে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে রাতের বেলায় বাড়ানো হচ্ছে পুলিশি টহল। ঈদের সময় ঢাকার রাস্তায় মানুষের চলাচল কমে যাবে। তখন আবাসিক এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানো হবে। রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। পাশাপাশি মহানগরের বিভিন্ন এলাকার স্বর্ণের বাজারে থাকবে পুলিশের কড়া নজরদারি। বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে বলেও জানায় ডিএমপি।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসাবে, প্রতিবার ঈদের আগের চারদিনে ঢাকা ছাড়ে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। সে অনুযায়ী এ সময় প্রতিদিন গড়ে বাড়ি ফেরে ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু এবার সে চাপ দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য সড়কে ফিটনেসবিহীন ও পুরনো যেসব যানবাহন চলতে দেখা যায়, এবার সেগুলোও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এ ঈদে অন্যান্যবারের তুলনায় যাত্রীচাপ অনেক কম। গত শুক্রবার ও শনিবার সকাল পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে রাজধানীর কয়েকটি বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশন ঘুরে দেখা যায়, যাত্রীচাপ এবার অন্যান্যবারের চেয়ে কম। বাসের ভেতরে বা ছাদে টিকিটের বাইরে যাত্রী পরিবহনের ঘটনাও এবার তেমন চোখে পড়ছে না। এছাড়া রেলস্টেশনে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শনিবার পোশাক কারখানার ছুটির পর প্রকৃত চিত্রটা বুঝা যাবে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর মতো পরিবহন সংশ্লিষ্টরাও একই কথা বলছেন। তাদের মতে, অন্যান্যবার ঈদযাত্রায় যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে বাড়তি গাড়ি যুক্ত করা লাগে। তবে এবারের ঈদে তেমন প্রয়োজনীয়তা তৈরি হচ্ছে না। যাত্রীদের চাপ অন্যান্য ঈদের তুলনায় কম। শেষ মুহূর্তে রবিবার কিছু যাত্রী ঢাকা ছাড়তে পারে। এ সময় চাপ বাড়তে পারে এমনটাই ধারণা করছেন তারা।
ঢাকা বিমানবন্দরের রেলওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গত শুক্রবার স্টেশনে যাত্রীদের চাপ অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। তেমন ভিড় দেখা যায়নি। আমরা ধারণা করছি, আজকে পোশাক কারখানা ছুটি হলে যাত্রীদের চাপ বাড়বে। এজন্য বুঝা যাচ্ছে না আসল ভিড়টা।
এবার ঈদে একমাত্র মেয়ের জামাইসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে নাটোরে যাওয়ার কথা ষাটোর্ধ মোখলেছুর রহমানের। অনেক পরিকল্পনার পরও শেষমেশে ঢাকা না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মোখলেছুর রহমান বলেন, কিছুই হয়তো হবে না। তারপরও যাওয়াটা বাতিল করলাম। কারণ নাতি-নাতনিসহ অন্যদের নিয়ে এসময় দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আর যেতে চাচ্ছি না। সবাই চলে গেলে বাসাও ফাঁকা থাকবে। চোরের ভয় আছে।
আবার অনেককে দেখা গেছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে পাঠালেও বাসা পাহারা দেওয়ার জন্য নিজে ঢাকা থেকে গেছেন। এমনই একজন রাজধানীর বাড্ডা থেকে বিমানবন্দর রেল স্টেশনে পরিবারের সদস্যদের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে এসেছিলেন ব্যবসায়ী নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী-সন্তানদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছি। সবাই চলে গেলে বাসা ফাঁকা হয়ে যাবে সেজন্য আমি ঢাকায় থেকে গেলাম। পরিস্থিতি বুঝে চাঁদ রাতে যেতেও পারি, নাও যেতে পারি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদে নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকল ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রোববার প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও বিস্তারিত জানানো হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতর উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে ও ঈদে বাসা-বাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিপণি বিতানের সার্বিক নিরাপত্তায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। নগরবাসীর নিরাপত্তায় ডিবি ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। নগরবাসীকে সাথে নিয়ে যে কোনও অপতৎপরতা রুখে দিতে ডিবি প্রস্তুত। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৫০টি থানা এলাকায় প্রতিদিন জননিরাপত্তা বিধানে দুই পালায় ডিএমপির ৬৬৭টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া মহানগর এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থানে ডিএমপি কর্তৃক ৭১টি পুলিশি চেকপোস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ইতোমধ্যে অক্সিলিয়ারি ফোর্স নিয়োগ করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, ঈদে মহল্লা, বাসা বা মার্কেটে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকলে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি, থানা বা ডিবিকে অবহিত করবেন। তাছাড়া ডিএমপির কন্ট্রোল রুমের নম্বর অথবা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ যোগাযোগ করা যেতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ফাঁকা ঢাকায় কোনও ধরনের নাশকতার হুমকি নেই। কোনও হুমকি থাকলে সেটা সবাইকে নিয়ে মোকাবিলা করা হবে। জনগণ ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করলে কেউ নাশকতা করতে পারবে না। এবার ঈদে সবাই ছুটি ভোগ করছে কিন্তু পুলিশ-বিজিবি-আনসার ছুটি কাটাচ্ছে না। তারা কিন্তু নিশ্চিদ্রভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ঢাকায় কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন ভালো থাকে এজন্য তারা কাজ করে যাচ্ছে— আপনারা যেন ভালোভাবে যেতে পারেন। আপনাদের বাসা-বাড়ি যেন ঠিক থাকে। এজন্য তারা সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।