পুরাতন বিশ্বব্যবস্থার অবসানে ইউরোপে নতুন পরিস্থিতি

মার্ক লিওনার্ড

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

সমগ্র ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা হয়, যেখানে মাইডাসের উল্টো স্পর্শ রয়েছে। অর্থাৎ তিনি যা স্পর্শ করেন, তার পরিণতি আরও খারাপ হতে থাকে। তবুও বেশির ভাগ ব্যাপারে তাঁর পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাদের যুগের নিখুঁত মূর্ত প্রতীক।

২০২১ সালে আমি ‘দ্য এজ অব আনপিচ’ বই লিখেছিলাম। সেখানে এই যুক্তি তুলে ধরেছিলাম, নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকা বা হাইপার-কানেকটিভিটির জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়মের ব্যাপারে নতুন করে ভাবনা শুরু করা উচিত। আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা ছিল, সেগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাণিজ্য, ইন্টারনেট, শক্তির উৎস, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, অভিবাসন, গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও ভোগান্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।

এই নতুন বিশ্বে লক্ষ্য করেছি, যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যকার সীমানা ক্ষয়প্রাপ্ত। আমরা মনে করেছিলাম, স্নায়ুযুদ্ধ শেষে আমরা শান্তির স্বর্ণযুগ পেয়েছি। এ ছিল ভুল। বাস্তবে সর্বত্র সহিংসতা ছিল। কিন্তু তা এসেছিল নিষেধাজ্ঞা, রপ্তানি ও জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনী হস্তক্ষেপ ও অভিবাসনকে হাতিয়ারে পরিণত করে। এ সবকিছুর জন্যই আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল।

আমার বই বাজারে আসার মাত্র কয়েক মাস পর ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে পুরোদমে আক্রমণ শুরু করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে পুরোনো নিয়মনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষত ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিতের পর থেকে এটি স্পষ্ট, বিশ্বকে দেখার জন্য আমাদের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। ট্রাম্প প্রশাসন পুরোনো সব ধরনের নীতি একসঙ্গে মিলিয়ে ছুড়ে ফেলেছে এবং সেগুলো তরল করে ছেড়েছে। যুদ্ধ ও শান্তি, মিত্র ও শত্রু, জাতীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ, অথবা বাম ও ডানের মধ্যকার স্পষ্ট কোনো পার্থক্য অবশিষ্ট নেই। ট্রাম্প বিশ্বের বাকি অংশের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি ইউক্রেন থেকে খনিজ সম্পদ লুট করার চেষ্টা এবং গ্রিনল্যান্ড ও পানামার আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি দিচ্ছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার পুরোনো নিয়মগুলো এখন কার্যকর থাকছে না।

দুর্ভাগ্যবশত এটি কেবল বিশৃঙ্খলার ব্যাপার নয়। এ ক্ষেত্রে ‘শৃঙ্খলা’ দেখতে কেমন তা নিয়ে কিছু মৌলিক ঐকমত্য থাকবে। এখানে তাও নেই। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা বিভিন্ন ঘটনার দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর সরকারগুলো হাইপার-কানেকটিভিটি বা নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকা এবং আন্তঃনির্ভরতার মধ্যে বিদ্যমান সংকটকে ঘোলাটে করেছিল, যা ২০০৮ সালের বাজার পতন থেকে সিরিয়ার শরণার্থী সংকট ও মহামারি পর্যন্ত। নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে নীতিনির্ধারকরাও অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে জরুরি ও ব্যতিক্রমী ব্যবস্থার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন এত বেশি ব্যতিক্রম তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন গর্তযুক্ত সুইস পনিরের মতো দেখাচ্ছে। এটি নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলার পরিবর্তে ব্যতিক্রমভিত্তিক শৃঙ্খলায় পরিণত।

ট্রাম্প এটি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি অভিজাতদের নিয়ে জনগণের হতাশার মধ্যে পতিত হয়েছিলেন। এই অভিজাতরা তাদের কাছে সব উত্তর রয়েছে বলে ভান ধরতেন। কিন্তু তারা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা করতে ব্যর্থ। আমেরিকানরা বিশ্বজুড়ে এমন অনেকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে, যারা সব সময় মনে করত, উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা একটি প্রতারণা। এটি অনেকটা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের মতো, যা পবিত্র ছিল না, রোমান ছিল না, এমনকি কোনো সাম্রাজ্যও ছিল না। আবু গারিব বা গুয়ানতানামো বে-তে নৃশংসতার পর উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে উদার বলা যায় না। বিশ্বের অনেক অঞ্চল যখন গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত ছিল তখন এটিকে আন্তর্জাতিক বলা যায় না। এই ব্যর্থতার কারণে এটিকে একটি শৃঙ্খলা বলারও সুযোগ নেই।

লেখক : পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ইউরোপীয় কাউন্সিলের পরিচালক; ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

শেয়ার করুন