মাদারীপুরে ‘শিরক’ আখ্যা দিয়ে শতবর্ষী একটি বটগাছ কেটে ফেলার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে। সদর উপজেলা শিরখাড়া ইউনিয়নের আলম মীরার কান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গাছ কাটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
খবর পেয়ে মঙ্গলবার (৬ মে) ঘটনাস্থল পরির্দশন করেছে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ।
দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, গাছটির গোড়ার দিকের কিছু অংশ এখনো অবশিষ্ট আছে। তবে এরইমধ্যে বেশিরভাগই কেটে ফেলা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আলম মীরার কান্দি গ্রামের কুমার নদের পাশে স্থানীয় সাত্তার হাওলাদারের মালিকানাধীন একটি বাগানের মধ্যে শতবর্ষী একটি বটগাছ ছিল। গত কয়েক বছর ধরে গাছটিকে ঘিরে স্থানীয়রা নানা কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন। স্থানীয় মুসলিম ও সনাতন ধর্মের কিছু মানুষ মনের বাসনা পূরণ, রোগ বালাই থেকে মুক্তি, সন্তান কামনাসহ নানা বিষয় নিয়ে মানত করতেন এই গাছে। গাছের গোড়ায় মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালাতেন। পাশাপাশি নতুন গামছা, কাপড়, মিষ্টি, নাড়ু, হাঁড়ি-পাতিলসহ নানা জিনিসপত্র রেখে যেতেন। এমনকি গাছের শিকর, ডালপালা ও মাটি নিয়ে যেতেন তারা।
সম্প্রতি বৈশাখকে ঘিরে এই বটগাছের নিচে মেলা ও বাউল গানের আয়োজন করেন স্থানীয়রা। তবে আলেম সমাজের বাধায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। তবে মানতের বিষয়টি চলতে থাকে।
সোমবার (৫ মে) সকালে আলেম সমাজ ও স্থানীয় জনতা মিলে গাছ কাটা শুরু করেন। সারাদিন তারা গাছটি কাটেন। গাছটির প্রায় সবই কেটে ফেলা হয়েছে। এখন বটগাছটির গোড়ার সামান্য অংশ কাটা বাকি আছে।
স্থানীয়রা জানান, পাশের গ্রাম মাদারীপুর সদর উপজেলার চরঘুনসি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর সাত্তার হাওলাদারের মালিকানাধীন গাছটি দেড় হাজার টাকায় আলেমরা কিনে নেন। সেই টাকা স্থানীয় মসজিদে দেবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করেও সাত্তার হাওলাদারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি সাংবাদিক দেখে ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েন এবং মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন।
গাছ কাটায় অংশ নেওয়া আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “গতকাল আমিও গাছ কাটায় অংশ নিয়েছি। এই গাছকে ঘিরে ‘শিরক’ চলে। গাছের গোড়ায় মোমবাতি, নতুন কাপড়, মিষ্টি দেওয়া হয়; যা পাপ, শিরক। আল্লাহ এগুলো মেনে নেবেন না। তাই শতাধিক আলেম ও জনতা মিলে গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে।”
স্থানীয় বাসিন্দা শারমিন বেগম বলেন, ‘আমি বিয়ের পর প্রায় ৩০ বছর ধরে গাছটি দেখে আসছি। সামান্য অজুহাত গাছটি কেটে ফেলা ঠিক হয়নি। গাছ কাটা বন্ধে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতো।’
মাহবুব হোসেন নামের আরেকজন বলেন, ‘গাছ আমাদের অনেক উপকারে আসে। নদী পার হয়ে এখানে বটের ছায়ায় অনেক মানুষ বিশ্রাম নিতো। পাপ ও শিরকের অজুহাত দিয়ে গাছটি কাটা ঠিক হয়নি। তবে এগুলো বন্ধের জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে পারতেন।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস মাদারীপুর জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা হাবিব আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, ‘বটগাছের গোড়ায় এমন কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। তাই কেটে ফেলা হয়েছে গাছটি।’
মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন বলেন, ‘এভাবে গাছটি না কেটে বাঁচিয়ে রাখা উচিত ছিল। যদি কেউ গাছের গোড়ায় মিষ্টি বা নতুন কাপড় দান কিংবা মোমবাতি বিতরণ করে থাকেন, তাহলে তাদের বোঝানো যেতো। এভাবে পুরোনো একটি গাছ কেটে ফেলা উচিত হয়নি।’
এ বিষয়ে মাদারীপুর বন বিভাগের জেলা বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ঘটনাটি আমরা জানি। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। তারা যে সিদ্ধান্ত দেন, সেভাবে পরবর্তী কাজ করা হবে।’
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, এটির পেছনে তৃতীয় কোনো পক্ষ কাজ করছে কি-না খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বন বিভাগ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “কোনোভাবেই ‘শিরক’ করা যাবে না। তবে এটি বন্ধ করতে শতবর্ষী বটগাছ কাটাও ঠিক হয়নি। যারা এসব কাজ করছেন তাদের বোঝানো যেতো। তাদের বুঝিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে শিরকের মতো গুনাহের কাজ বন্ধ করলে ভালো হতো। গাছটি বেঁচে থাকলে মানুষসহ বিভিন্ন পাখিদেরও অনেক উপকারে আসতো।”