নির্বাচনই নির্বাচনের বিকল্প

মোস্তফা কামাল

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল। সংগৃহীত ছবি

কারণ স্পষ্ট না হলেও আলামতে দ্রুত নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা ঘুরছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেই কবে ভোট দিতে পেরেছে, তা ভুলেও গেছে। তারা ভোট দিতে মরিয়া। আর ভোট করতেই গঠন করা হয়েছে নতুন একটি নির্বাচন। ডিসেম্বরে টাইমলাইন ধরে কমিশন ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। তার কমিশনের মূল কাজ নির্বাচন আয়োজন করা। না করা নয়। তারপরও কেন ঘুরছে নির্বাচন দ্রুত না হওয়ার শঙ্কা?

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্পষ্ট ঘোষণা পরবর্তী নির্বাচনটি হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানিয়েছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করবেন তিনি। তার টাইম ফ্রেম ধরলে সেই ক্ষণটি দাঁড়ায় আগামী মার্চে। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে জুনের মাঝামাঝি। উপরোক্ত ৩ জন ( প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার) এর নির্বাচন প্রশ্নে এখন পর্যন্ত নতুন বা বাড়তি কথা নেই, যার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন পেছানোর ধারণা মেলে না। কিন্তু, ধারণার বাইরে অপরাপর কারো কারো কথা ও মন্তব্যে বাঁধছে ফ্যাকড়া। একজন উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি শুনেছেন মানুষ বলছে এ সরকারই আরো ৫ বছর ক্ষমতায় থাক। আরেকজন উপদেষ্টা বলে বসেছেন, এ সরকারকে অনির্বাচিত বলা ঠিক নয়। ৫ আগস্টের ঘটনার জেরে ৮ আগস্ট এ সরকার এক ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমেই শপথ নিয়েছে।

এর মধ্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছেন আলোচিত একজন চিন্তক। তার মতে, এখন নির্বাচনেরই দরকার নেই। একটি দলকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচন হলে দুর্বৃত্তরাই বিপুল ভোটে ক্ষমতায় বসবে। নামকরা এক ইসলামী বক্তা আরো খোলাসা করে বলেছেন- একদল খেয়ে গেছে, আরেকদল খেতে চায়। আরো জনা কয়েক আলেম মাঠে-ময়দানে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে মোনাজাতে বলে বেড়াচ্ছেন, ড. ইউনূস যতোদিন বাঁচবেন ততদিন যেন আল্লাহ এ দেশে নির্বাচন না দেন। ওয়াজের শ্রোতা মুসল্লিদের আমিন-আমিন ডাকিয়ে কাঁদিয়ে ছাড়ছেন। এর বাইরে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনার কয়েকজন গণহত্যার বিচার চাইতে গিয়ে জোসের বশে বলে বসছেন, গণহত্যার বিচারের আগে কিসের নির্বাচন? এ ধরনের নানা কথার ঢোলের বাদ্যে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখি দলগুলোর মধ্যে একটি সংশয়-শঙ্কা ভর করেছে। তারা এসব উড়া কথার মাঝে সরকারের উপদেষ্টাদের কারো কারো সংযোগ দেখছেন।

এ নমুনায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে সন্দিহান। তা গোপন না রেখে দলটির নেতারা নিয়মিত প্রকাশ্যে বলছেন, নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচনের দাবি আদায়ে প্রয়োজনে আবার রাজপথে নামার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। আর তাদের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু সরকার। বিএনপি বা অন্য কোনো দল যা-ই বলুক বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি চলছে, তার লাগাম টানতে একটি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন নিয়ে যত অনিশ্চয়তা হবে জটিলতা তত বাড়বে। কথা-কাজে ভর করবে সংঘাত-সহিংসতা।

টানা নয়টি মাস ধরে নানা জটিল এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি তত জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সরকার পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টায় কোনো কমতি করছে, এমনও নয়। কিন্তু, কুলাচ্ছে না। এর মূল কারণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীনতা। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সকল উপদেষ্টা ও তাদের এসোসিয়েটের প্রায় সবাই কর্মঠ। কয়েকজনের শিক্ষা- সততা-দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই তাদের। তুলনামূলক কম শিক্ষিত রাজনীতিকরা কোনো কানো কাজ যেভাবে ম্যাজেশিয়ানের মতো করে ফেলতে পারেন, বিশাল এই অ্যাকাডেমিশিয়ানরা অনেক ঘামে-শ্রমেও পারছেন না।

মানুষ পতিত সরকারের অপকর্মের বিচার চায়। সংস্কারও চায়। কিন্তু, তা নির্বাচন বাদ দিয়ে নয়। নির্বাচন-সংস্কার-বিচার একটি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। একটি আরেকটির বিকল্পও নয়। এগুলো নিয়ে সিরিয়াল ঠিক করা বা একটি বাদ দিয়ে আরেকটিকে বেশি সামনে নিয়ে আসার পেছনে এক ধরনের দুষ্টচর্চা গত কিছুদিনে অনেকটা স্পষ্ট। গোলমাল বাঁধাতে পেরে তারা কিছুটা সফলও। যার জেরে নির্বাচন কবে হবে, এই প্রশ্নে অনিশ্চয়তার তেজ বাড়ছে। বাড়তি কথাও যোগ হচ্ছে অতিমাত্রায়। ভোটের ব্যাপারে উতলা সাধারণ জনগোষ্টিও এতে অসন্তুষ্টু। বাংলাদেশে নির্বাচন হয় সাধারণত শীতকালে। বেশিরভাগ নির্বাচন হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে।

নিজে কোনো দল না করলেও এ দেশের অনেকের কাছে নির্বাচন একটা উৎসবের মতো। তার বা তাদের ব্যক্তিগত কোনো লাভ না থাকলেও নির্বাচনে মাতোয়ারা হওয়া মাঠে মেরে ছেড়েছে গত সরকার। চায়ের আড্ডা, নির্বাচনি মিছিল, ক্যাম্পেইনে শরিক হতে পারাও তাদের কাছে একটি অর্জনের মতো। আবার বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীদের কাছেও নির্বাচিত সরকার অত্যন্ত আকাঙ্খিত। সেই আকাঙ্খারও কবর দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেছে কোনো মতে টিকে থেকে। ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ ঘটেছে, ব্যথায় কাঁতরাতে পারেনি। পায়নি বিনিয়োগকৃত পুঁজির গ্যারান্টি। সাধারণ মানুষের চেয়ে ব্যবসায়ীরা গণতন্ত্রায়ণ, সরকারের স্থায়িত্ব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরেকটু বেশি চায়।

রাজনীতি, ব্যবসা, বিনিয়োগে সরকারই সব নয়। সব শ্রেণি, বিশেষ করে বেসরকারি সেক্টরের শরিকানা-সম্পৃক্ততা জরুরি। সেইক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আস্থা ও আয়ত্বে নেয়ার বিষয় রয়েছে। কিন্তু, গণহারে ব্যবসায়ীদের শত্রু জ্ঞান করতে গিয়ে তাদেরও এক খাতায় ফেলে দেয়া হচ্ছে। এর অবসানে দরকার একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ঋণখেলাপি গালমন্দে তাবৎ ব্যবসায়ীদের একাকার করে ফেলার হিল্লা করতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই। কে না জানে কিছু ঋণ তো দেওয়াই হয়েছিল তা ফেরত না নেওয়ার জন্য। বকশিশ, স্পিড মানির নামাবলিতে ঘুষ সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। অর্থ পাচারকারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তার কথাও গোপন নেই।

রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সেইসব বন্দোবস্তের লাগাম না টানলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক হবে না। তা বুঝতে মস্ত অর্থনীতিবিদ হওয়া জরুরি নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোধগম্য সরকারিভাবে ৫-৭ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। বাকিদের কর্মসংস্থানের ভরসা বেসরকারি সেক্টর। অথবা বিদেশ চলে যাওয়া। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের দাবিতেই গেল আন্দোলনের সূচনা। যা পরে গড়ায় সরকার পতনে। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পর একটি আন্দোলনের মুখে সরকার এসেছে। এ সরকারের কাছে নতুন অনেক প্রত্যাশা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকলাঙ্গ দশা কাটানোর দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে। বেসরকারিদের ঘুরে দাঁড় হতে দেওয়ার সুযোগ তৈরির দায়িত্বও তার। এডহক নয়, টেকসই উন্নয়ন ছাড়া এ আঁধার কাটবে না। আর সেটা বাস্তবায়নে সরকার এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় অত্যাবশ্যক। রাজনৈতিক এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে তা অনেকটা সহজ। অরাজনৈতিক সরকার সাধারণত এ সমন্বয়ের কাজে কুলায় না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন