স্বীকার করতেই হয় যে, দীর্ঘকাল ধরেই শনির দশা চলছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। সমস্যা সমাধানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় দিন দিন এর অবস্থা তাই খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় পুঁজিবাজার: দর্শন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক সংলাপেও পুঁজিবাজারের করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে।
বলতে হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংকট উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল অন্তত অতি উৎসাহী কিছু মানুষের মনে। কিন্তু সংকট যে আরও বেড়েছে! বাজারে প্রায় প্রতিনিয়তই দরপতন হচ্ছে। লেনদেনের পরিমাণ একেবারেই কমে গেছে। ব্যাংক খাতে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দৃশ্যমান হলেও শেয়ারবাজার যেন উল্টো পথে হাঁটছে। যে কারণে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থাই তৈরি হচ্ছে না।
আসলে পুঁজিবাজারে কারসাজির শাস্তি না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে কেউ এর প্রকৃত দায়িত্ব গ্রহণ না করাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। জানা যায়, সেই ১৯৯৬ সালে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছিল, কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম বাড়তে থাকে। বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাভ করছে আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যেন তাদের লাভের জোগান দিচ্ছেন!
মনে রাখা চাই, আস্থার অভাব এবং পারস্পরিক সহযোগিতার অনুপস্থিতিতে পুঁজিবাজারের এই দুরবস্থা কেবল আর্থিক ক্ষতিই করছে না, বরং পুরো অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে দরপতন হলেও ফের ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু আমাদের দেশে যে সেই সূত্র কাজ করে না! আসলে এখানে কারসাজি এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আর এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমেই, পুঁজিবাজারে পূর্বে সংঘটিত সব কারসাজি ও অনিয়মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি যত দিন থাকবে, তত দিন নতুন করে অনিয়মকারীরা উৎসাহিত হবেন। তারপর পুঁজিবাজারকে রাজনৈতিক মালিকানার (ওনারশিপ) আওতায় আনতে হবে, যার জন্য সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়াও পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য আর্থিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। এতে বাজারের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন। সবশেষে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অবশ্য এসবের জন্য প্রয়োজন বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
সবশেষে বলতে হচ্ছে, সংশ্লিষ্টদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, পুঁজিবাজার শুধুই কিছু মানুষের লাভের উৎস নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতিরও চালিকাশক্তি। তাই পুঁজিবাজারকে শনির দশা থেকে মুক্ত একটি সুস্থ, শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য বাজারে পরিণত করা প্রয়োজন।