বন্ধ হোক ইরান-ইসরায়েল সংঘাত

সম্পাদকীয়

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রতীকী ছবি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত শুধু একটি আঞ্চলিক লড়াই নয়, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য, সামরিক প্রযুক্তি, ধর্মীয় মতাদর্শ ও আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দ্বের প্রতিফলন বলেই চিহ্নিত করা যায়। সংঘর্ষের সূচনা হয় ১৩ জুন রাতে ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক হঠাৎ বিমান হামলার মাধ্যমে, যা ছিল ইরানের সামরিক স্থাপনা ও পারমাণবিক সুবিধা লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি কৌশলগত আক্রমণ। ইসরায়েল দাবি করে, এই অভিযানে তারা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ও সংরক্ষণ ঘাঁটির এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেনি। তারা ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’ নামের পাল্টা অভিযান শুরু করে, যাতে ১০০টির বেশি ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং শতাধিক ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে কিছু ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

এদিকে, ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও ইরানে হামলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানে হামলায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও যোগ দেবে কি না, সেটা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে বেশি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন মন্তব্য ও তৎপরতায়ও সেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ওই বৈঠক নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। আলোচনা সম্পর্কে জানেন, এমন পাঁচটি সূত্র বলেছে, সেই বৈঠকে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা শুরু করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ইরানে হামলা চালানোর বিষয়ে ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন। ইরানে ওয়াশিংটনের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে তেহরান। ইরান আত্মসমর্পণ করবে না মন্তব্য করে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি গতকাল বলেন, এটা করলে যুক্তরাষ্ট্রকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো এলি জেরানমায়েহর মতে, ট্রাম্প ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নিলে ইরান সেটা তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে।

এদিকে টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বুধবার (১৮ জুন) পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে ইরান ও ইসরায়েল। ইরানের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলে ব্যালিস্টিকের পাশাপাশি গতকাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।

গণমাধ্যমে আসা উভয় দেশের সামরিক সাফল্য যেমন আংশিক, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির হিসাবও বিভ্রান্তিকর। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, তারা ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, ইরান বলছে—তাদের পরমাণু স্থাপনাগুলোর সিংহভাগ ভূগর্ভস্থ এবং অক্ষত আছে। ইসরায়েলেরও ক্ষয়ক্ষতির কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ পেলেও সরকারি বিবৃতিতে সে সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু বলা হয়নি। ইরানের ৬০০-৬৩৯ জনের মৃত্যুর কথা শোনা গেলেও নিশ্চিত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, আর ইসরায়েলেও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ২৪-২৫ জন নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।

এই সংঘর্ষের কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং তার আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করা। অন্যদিকে, ইরানের পাল্টা হামলার উদ্দেশ্য ছিল কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং নিজেদের সামরিক সক্ষমতা ও জনসমর্থন তুলে ধরা, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু যুদ্ধ যে শুধু সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস বা ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি জনমনে ভয়, আতঙ্ক এবং দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা ছড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি৭ জোট, এমনকি রাশিয়া ও চীনও শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। তারা চায় দুই দেশ যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার পথে ফিরে যাক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যেখানে তিনি সরাসরি ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘তেহরান শহর পুরোপুরি খালি করে ফেলা উচিত’। ট্রাম্পের এ ভাষা যুদ্ধোন্মাদনা বাড়াতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষকের মত।

প্রশ্ন হচ্ছে—এই সংঘাত কি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে, নাকি এটি হবে সীমিত আকারের, বারবার আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? বাস্তবতা হলো, উভয় দেশই জানে যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। আর এই মুহূর্তে বাস্তবতা হলো—ইসরায়েল আক্রমণে কিছুটা এগিয়ে এবং ইরান কৌশলগতভাবে তা প্রতিহত করেছে। উভয়েরই সামরিক সক্ষমতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, তবে কোনো পক্ষ চূড়ান্ত জয় পায়নি। তবে এই সংঘর্ষ এখনই থামবে না, কিন্তু সেটি কোন দিকে মোড় নেবে—তা নির্ভর করছে কূটনৈতিক সমঝোতা, আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।

আমরা মনে করছি, যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ এখনো বিজয়ী নয়, বরং উভয়েই ক্ষতবিক্ষত এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় বন্দী। বাস্তবতা হলো, এই সংঘর্ষ যত দীর্ঘ হবে, এর পরিণতি তত ভয়াবহ হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষজনের জন্য ততই অশান্তি ডেকে আনবে। প্রসঙ্গত, যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি শান্তিও আজ সবচেয়ে জরুরি এবং মানবিক কর্তব্য।

শেয়ার করুন