বিশ্বজুড়ে বাড়ছে বাংলাদেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী

মত ও পথ ডেস্ক

কোলাজটি সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ক্রমে বাড়ছে। এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের ঠাঁই নেওয়ার প্রবণতা বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর জাতিসংঘের কাছে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৭৩ বাংলাদেশি। একই বছর ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ডেটাসেট থেকে এমন তথ্য মিলেছে।

এসব বাংলাদেশি ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, সাইপ্রাস, বসনিয়া, অস্ট্রিয়ার মতো দেশে নিবন্ধন করেছেন। এ ছাড়া উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা; দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকংয়ের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও বাংলাদেশিরা ঠাঁই খুঁজছেন। এমনকি ‘দুর্ভিক্ষের দেশ’ সোমালিয়াতেও গত বছর নিজেদের শরণার্থী পরিচয় দিয়ে ছয় বাংলাদেশি সেখানে থিতু হয়েছেন।

এ পটভূমিতে আজ শুক্রবার নানা আয়োজনে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি’। ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে একশ্রেণির তরুণের মধ্যে যে কোনো কায়দায় বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ সুযোগটিই নিচ্ছে মানব পাচারকারী চক্র। ভূমধ্যসাগর এবং লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও ইতালির উপকূল থেকে ঘন ঘন আসছে বাংলাদেশির মৃত্যুর দুঃসংবাদ। পাচারের বিভিন্ন পথ থেকে প্রতিনিয়ত উদ্ধার করা হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। উদ্ধার হওয়া এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীর বেশির ভাগকেই আইওএমের সহযোগিতায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে দেশে। এখন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে বাংলাদেশি তরুণদেরও দেখা মিলছে। এসব বাংলাদেশিকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে মানব পাচারকারীরা।

কত শরণার্থী

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ২৪ হাজার ১২৬ বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘের কাছে নিবন্ধিত হয়েছেন। ২০২২ সালে ২৩ হাজার ৯৩৫ জন, ২০২১ সালে ২২ হাজার ৬৭২ এবং ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৯৪৮ বাংলাদেশি নিজেদের শরণার্থী দাবি করে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেন। পাশাপাশি ২০১৯ সালে শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশিদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৭৬৬, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২ এবং ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ৭৮০।
২০২৩ সালে ৭৫ হাজার ৮৬৭ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ২০২২ সালে ৬১ হাজার ২৯৮, ২০২১ সালে ৬৫ হাজার ৪৯৫ এবং ২০২০ সালে ৬৪ হাজার ৬৩৬ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ৮৬০ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আবেদনকারী বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই বিগত সময়ে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফায়দা নিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি আদতেও রাজনৈতিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তবে জাতিসংঘের তথ্যে যে চিত্র উঠে এসেছে, এদের বেশির ভাগই ‘সুযোগসন্ধানী’।

মানব পাচারকারীর জাল

বিদেশ যেতে চাইলে বাংলাদেশিরা মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়েন। গ্লোবাল অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মানব পাচারই এখন সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত আন্তঃদেশীয় অপরাধ সূচকে মানব পাচারের ভয়াবহতার ১০ পয়েন্টে বাংলাদেশের সূচক মান ৮। বর্তমানে দেশ থেকে শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, রোহিঙ্গারাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। মানবপাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

অনেক বাংলাদেশি শুধু বিদেশ যাওয়ার আশায় দালালদের অর্থ দেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইউরোপ যাওয়ার লোভে ভূমধ্যসাগর হয়ে ভয়াবহ পথে যাত্রা করেন। প্রতিবছরই এ অঞ্চলে বাংলাদেশিদের সলিল সমাধির খবর আসে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে ফেরত পাঠায়। এদের অনেকে আবার একই পথে পা বাড়ান, অনেকে সফলও হন। আবার অনেককে পাচারকারীরা তৃতীয় কোনো স্থানে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে।

বর্তমানে দুর্গম পথের বাইরেও ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশিদের পাচার করে থাকে পাচারকারীরা। এ ক্ষেত্রে মাথাপিছু গড়ে ২০ লাখ টাকা খরচ পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানব পাচারকারীদের বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। দূতাবাসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা মোটা অর্থের বিনিময়ে ভিসা পেতে সহায়তা করেন।

কূটনীতিকরা বলছেন, অনেক কূটনীতিকের জন্য বাংলাদেশ একটি সোনার খনি। কারণ এখানকার অনেকে বিদেশে যেতে উন্মুখ হয়ে থাকে। সে তুলনায় বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার সংখ্যা কম। এ সুযোগই নেন মানব পাচারকারীর যোগসাজশে এক শ্রেণির অসাধু কূটনীতিক। দেশগুলো জানে, যেখানে বাংলাদেশিরা যাচ্ছেন, সেখানে থাকবেন না। দেশটিকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করবেন মাত্র।

কারা কী বলছেন

কূটনীতিকদের ভাষ্য, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই অর্থনৈতিক কারণে দেশ ছেড়েছেন। করোনা মহামারির সময় দেশে আয়ের সুযোগ কমে যাওয়া এবং বৈধ পথে বিদেশ যাওয়া সংকুচিত হওয়াও দেশ ছাড়ার বড় কারণ। পাশাপাশি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতিও কয়েক বছরে এ প্রবণতা বাড়িয়েছে।

বিদেশে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যাটি দেশের জন্য সম্মানজনক নয় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, দুটি কারণে বিশ্বে বাংলাদেশি শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাড়ছে। একটি, বাংলাদেশিরা যখন বিদেশ ভ্রমণে যান, তখন যেনতেনভাবে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এরা হচ্ছেন সুযোগসন্ধানী। এর বাইরে কিছু বাংলাদেশি প্রকৃত অর্থে শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে যোগ্য। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে সুযোগসন্ধানীদের কারণে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃতদের সুযোগ কমে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করে দেশের একটি গণমাধ্যম। তবে তাঁর সঙ্গে কথা সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে মেসেজ প্রশ্ন পাঠিয়েও বক্তব্য মেলেনি বলে জানা গেছে।

শেয়ার করুন