ছোটবেলায় প্রতিদিন সকালে রুটির সঙ্গে ক্যাভিয়ার খেতেন আদিলবেক কোজিবাকভ। তার মা বিশ্বাস করতেন, এই সামুদ্রিক খাবার শরীর ভালো রাখে। অথচ, আজ তিনি সেই দিনগুলোর কথা শুধু স্মৃতিতে খুঁজে ফেরেন।
আদিলবেক কোজিবাকভ বেড়ে উঠেছেন কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত কাজাখস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আকতাউতে। আজ বয়স এখন ৫১। তিনি একজন পরিবেশবিদ। কাজ করেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ বিষয়ক একটি নাগরিক পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য হিসেবে। কিশোর বয়সের সেই দিনগুলো মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে তার স্মৃতির পাতায়।
সেই স্মৃতিচারণ করে কোজিবাকভ বলেন, আমার তখন ভালো লাগত না ক্যাভিয়ার। কারণ, সেটিতে অতিরিক্ত লবণ আর সাগরের গন্ধ ছিল। কিন্তু চার দশকেরও বেশি সময় পর আজ সেই সাগরের রূপটাই বদলে গেছে। দোকানে প্রাকৃতিক ক্যাভিয়ার আর পাওয়া যায় না। স্টারজন মাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। অতিরিক্ত শিকার আর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের অস্তিত্ব। আর শুধু মাছ নয়, ধীরে ধীরে সাগরটিই হারিয়ে যেতে বসেছে।
এপ্রিল মাসে ‘ন্যাচার’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, চলতি শতাব্দীর শেষে কাস্পিয়ান সাগরের পানির স্তর ১৮ মিটার পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে সাগরের আয়তন হারাবে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এমনকি মাত্র ৫ থেকে ১০ মিটার পানির স্তর কমে গেলেই চরম হুমকির মুখে পড়বে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র। বিশেষ করে কাস্পিয়ান সিল ও স্টারজনের মতো স্থানীয় প্রাণী প্রজাতির অস্তিত্ব।
কোজিবাকভ বলেন, সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝতে আমাদের কোনো গবেষণার দরকার নেই। খালি চোখেই তা স্পষ্ট দেখা যায়।
রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজানের মাঝে অবস্থিত কাস্পিয়ান সাগরকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থলবেষ্টিত জলরাশি। এটি ‘মিডল করিডোর’র অংশ, যা চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের দ্রুততম রুট। একই সঙ্গে এটি বিশাল এক জ্বালানির ভাণ্ডার।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, কাস্পিয়ান সাগরের পরিণতিও যেন অ্যারাল সাগরের মতো না হয়। সোভিয়েত আমলে অতিরিক্ত নদীর পানি তুলেই অ্যারাল সাগর প্রায় শুকিয়ে যায়। এখন এটি তার আসল আয়তনের মাত্র ১০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে।
গবেষকেরা বলছেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয় কাস্পিয়ানের সংকটে বড় ভূমিকা রেখেছে রাশিয়ার পানি ব্যবস্থাপনা। সাগরের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ পানি আসে রাশিয়ার ভলগা নদী থেকে। ভলগা ইউরোপের দীর্ঘতম নদী। এ নদীতে বহু বাঁধ ও জলাধার তৈরি করে কৃষিকাজ ও শিল্পের জন্য। ব্যাপক হারে পানি ব্যবহারের কারণে নদীর প্রবাহ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
কোজিবাকভ বলেন, একসময় স্টারজন মাছ কয়েক দশক বাঁচত। বিশাল আকৃতির মাছগুলো দেখা যেত পুরনো ছবিতে। কিন্তু এখন চোরাকারবারি আর তেল কোম্পানির দূষণে এসব মাছ প্রায় বিলুপ্ত।
তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিখ্যাত কাজাখস্তানের তিনটি প্রধান তেল ক্ষেত্র পরিচালনা করে বিদেশি কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাজাখস্তানের পরিবেশ আইনজীবী ভাদিম নি সরকারকে আদালতে টেনে নিয়ে গেছেন। তার দাবি, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করা চুক্তিগুলো গোপন রাখা হয়েছে। ফলে পরিবেশের ওপর সাগরের প্রকৃত প্রভাব জানা যাচ্ছে না।
নব্বইয়ের দশকে স্বাধীনতার পর কাজাখস্তান তার বিশাল জ্বালানিভাণ্ডার বিদেশে রপ্তানির করার উদ্যোগ নেয়। তারপর বিভিন্ন চুক্তি করে দেশটি। আন্তর্জাতিক ব্যক্তিগত আইনের আওতায় এসব চুক্তি গোপন রাখা হয়, যাতে বিরোধ সৃষ্টি হলে আন্তর্জাতিক আদালতেই নিষ্পত্তি হয়।
নি বলেন, এটি আরহুস কনভেনশন অনুযায়ী বে-আইনি। কারণ এই আন্তর্জাতিক চুক্তি নাগরিকদের পরিবেশগত তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে।
তিনি আরও বলেন, তেল কোম্পানিগুলো দায় স্বীকার ও আয়ের ক্ষতি করতে চায় না। তারা গবেষণা করলেও সেটি নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ তাদের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত। কাস্পিয়ান ঘিরে এখন ‘গ্রিন এনার্জি’র কথাও শোনা যাচ্ছে। হাইড্রোজেন উৎপাদনে জার্মান বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু এই বিদ্যুৎ যাবে ইউরোপে, আর দূষণ থেকে যাবে এখানকার পরিবেশেই।
তার মামলাটি আদালত গ্রহণ করেনি। আপিলে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
অন্যদিকে, আদিলবেক কোজিবাকভ এখনো লড়ে যাচ্ছেন মাঠ পর্যায়ে। তিনি স্থানীয় প্রশাসন, বাসিন্দা ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছেন কাস্পিয়ান রক্ষায়। কোজিবাকভ বলেন, আমরা চাই একেবারে গোড়া থেকে সরকারকে জানাতে যে মানুষ চিন্তিত। শুধু পরিবেশবিদ নয়, আকতাউয়ের সাধারণ মানুষ যারা এখানে জন্মেছে, তাদের সন্তান-নাতিদের ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন।