বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) অর্থাৎ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে হওয়া উচিত কি না—প্রশ্নটি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। একাধিক রাজনৈতিক দল যেমন এই পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে, তেমনি বিএনপির মতো বড় একটি দল এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই পদ্ধতি মূলত ভোট ও আসনের মধ্যে একধরনের আনুপাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে একটি দল জাতীয়ভাবে যত শতাংশ ভোট পায়, তাদের সংসদে আসনের সংখ্যাও সেই অনুপাতে নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের মতো একটি বহুমাত্রিক রাজনীতির দেশে, যেখানে কিছু দল ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং যেখানে ছোট বা মধ্যম আকারের দলগুলো প্রায় ভোটের বাইরে চলে যায়, সেখানে এই পদ্ধতি অনেক বেশি ন্যায়সংগত বলে অনেকে মনে করেন। আবার বাস্তবতাকে বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে, এই পদ্ধতির কিছু দুর্বলতাও রয়েছে, যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
পিআর পদ্ধতির মূল যে সুবিধা, তা হলো, এতে ভোটের প্রতিফলন সংসদে আরও সঠিকভাবে ঘটে। একজন ভোটার যখন ভোট দেন, তিনি আশা করেন, তাঁর মত বা আদর্শের প্রতিনিধিত্ব সংসদে থাকবে। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে যিনি শুধু সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই জয়ী হন। যদি একটি নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রার্থী ৩৫ শতাংশ ভোট পান এবং বাকি ৬৫ ভাগ ভোট অন্যদের মধ্যে বিভক্ত থাকে, তবু তিনিই নির্বাচিত হন। এর মানে হচ্ছে, ৬৫ শতাংশ ভোটারের মতামত অবজ্ঞা করা হলো। আবার জাতীয়ভাবে যদি কোনো দল ২০-২৫ শতাংশ ভোট পায়, কিন্তু তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিত্তবৈভবের অভাব বা একক আসনে জেতার সক্ষমতা না থাকায় তারা একটি আসনও না পায়, তাহলে সেটি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হয়। পিআর পদ্ধতিতে এই সমস্যাগুলোর অনেকটাই সমাধান হতে পারে। এখানে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে সংসদে আসন বরাদ্দ হয়। ফলে ছোট দল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, এমনকি নতুন রাজনৈতিক দলও সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়। এতে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়ে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের কণ্ঠস্বর সংসদে উঠে আসে।
তবে পিআর পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন এই পদ্ধতিতে সচরাচর একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, ফলে সরকার গঠন করতে হয় জোটের মাধ্যমে। অনেক দেশে দেখা গেছে, জোট সরকার অস্থিরতা সৃষ্টি করে, সরকার বারবার ভেঙে পড়ে বা জোটসঙ্গীদের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়। ইসরায়েল বা ইতালির রাজনৈতিক ইতিহাস এ বিষয়ের প্রমাণ। আরেকটি বড় সমালোচনা হলো, পিআর পদ্ধতিতে ভোটার-প্রতিনিধি সরাসরি সম্পর্ক হারিয়ে যায়। বর্তমানে একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন সংসদ সদস্য থাকেন, যিনি তাঁর এলাকার জনগণের জন্য সরাসরি দায়বদ্ধ থাকেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে এমনটি হয় না। প্রার্থী নির্বাচিত হন দলীয় তালিকা থেকে, ফলে তাঁর জবাবদিহি দলের কাছে, জনগণের কাছে নয়। এই পদ্ধতিতে দলীয় হাই কমান্ডই প্রায় সব নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্য, তোষামোদ ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতা আরও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে, যদি ‘ক্লোজড লিস্ট’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে তালিকা প্রস্তুতকারীরা অঘোষিতভাবে সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করবেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিআর পদ্ধতির বিভিন্ন রূপ ব্যবহার করা হয়। জার্মানিতে মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, যেখানে অর্ধেক আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় এবং বাকি অর্ধেক আসনে দলীয় ভোটের ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচন হয়। নেদারল্যান্ডস বা ইসরায়েলের মতো দেশে পুরো দেশকেই একটি একক আসন হিসেবে ধরা হয় এবং দলীয় ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকাও পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করে, যা তারা বর্ণবাদ-পরবর্তী নতুন সংবিধানে যুক্ত করেছে। এসব উদাহরণ আমাদের সামনে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এসব দেশের মতো নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তাদের বাইরের দলগুলো প্রায় গৌণ ভূমিকা পালন করে, সংসদে তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অথচ জাতীয় পর্যায়ে ছোট দলগুলো ৩-৫ শতাংশ বা তার বেশি ভোট পায়, যদি পিআর পদ্ধতিতে গণনায় আসত, তাহলে তারা সংসদে একটি দৃশ্যমান অবস্থান পেতে পারত। আবার বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে একটি দল ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮০ শতাংশ আসন পেয়ে গেছে; কারণ, তারা প্রতিটি আসনে অল্প ব্যবধানে জিতেছে। এটা সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং নির্বাচনী কৌশল ও ভাগ্যনির্ভর একক আধিপত্য। এই অসমতা ঘোচাতে পিআর একটি গ্রহণযোগ্য পথ হতে পারে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসার রাজনীতি ও সমঝোতার সংস্কৃতির অভাব। পিআর পদ্ধতি যেখানে বহু দলকে একসঙ্গে সংসদে বসার সুযোগ দেয়, সেখানে আমাদের রাজনীতিতে সেই সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দলগুলো আপসহীন, সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ এবং ছোটখাটো মতপার্থক্যেও সংঘাতের আশঙ্কা থাকে। এই বাস্তবতায় যদি হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতি চালু করা হয়, তাহলে সংসদ অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আবার নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, আইনগত কাঠামো, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, গণনা পদ্ধতি ও নির্বাচনী ট্রান্সপারেন্সি—সবকিছু নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।
এরপরও আমরা যদি গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা অর্জনের পথে এগোতে চাই, তাহলে পিআর পদ্ধতির কথা আমাদের চিন্তাভাবনায় রাখতে হবে। তবে সেটি এক লাফে নয়, ধাপে ধাপে। যেমন ধরুন, শুরুতে সংসদের একটি নির্দিষ্ট অংশ—ধরা যাক ১০০টি আসন—পিআর ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যেতে পারে, বাকি ২০০টি চলবে বর্তমান নিয়মে। এই ‘হাইব্রিড মডেল’ আমাদের জন্য বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত একটি পথ হতে পারে। এতে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য আসবে, আবার একক প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিও বজায় থাকবে। একে আমরা বলি মিশ্র পদ্ধতি, যেটি জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডে সফলভাবে চলছে।
তবে এই পরিবর্তনের আগে কিছু প্রস্তুতি দরকার। প্রথমত, সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও দক্ষ হতে হবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে আপসহীন অবস্থান থেকে সরে এসে গণতন্ত্রকে অংশগ্রহণমূলক করে তোলার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। চতুর্থত, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা নতুন ভোটপদ্ধতির জটিলতা বুঝতে এবং সঠিকভাবে অংশ নিতে পারেন। আর সবশেষে দরকার নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ, যারা এই রূপান্তরের সঠিক ব্যাখ্যা ও পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে বিএনপির বিরোধিতা একেবারে অযৌক্তিক বলা যায় না। তারা হয়তো মনে করে, দলীয় ভোটের ভিত্তিতে আসন নির্ধারণে ক্ষমতাসীন দল অন্য দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তাদের কণ্ঠরোধ করবে অথবা প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে দলীয় ভোটও নিজেদের করে নেবে। আবার পিআর পদ্ধতি চালুর নামে সরকার হয়তো সাংবিধানিক রদবদলের মাধ্যমে নিজের সুবিধা নিশ্চিত করতে চাইছে—এই সন্দেহ বিএনপির থাকতে পারে। তবে প্রকৃতপক্ষে পিআর পদ্ধতি একটি নিরপেক্ষ ও সমান অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যদি সব দল একযোগে এতে সম্মত হয় এবং একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামোতে একমত হয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রে আমরা যদি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈচিত্র্যময় ও জবাবদিহিমূলক সংসদ চাই, তাহলে পিআর পদ্ধতির কথা আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এটা নিছক একটি নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্ন নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চরিত্র গঠনের প্রশ্ন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই সংস্কৃতিতে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত? যদি প্রস্তুতি না থাকে, তাহলে এই পদ্ধতি ব্যর্থ হবে এবং আরও বিভ্রান্তি তৈরি করবে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনগত কাঠামো ও সামাজিক প্রস্তুতি থাকে, তাহলে এটি হতে পারে আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এক নতুন ও ইতিবাচক অধ্যায়।
ভোট যেন শুধুই সংখ্যা না হয়, তা যেন জনগণের কণ্ঠে রূপ নেয়—এই লক্ষ্যেই আমাদের এগোতে হবে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সেই পথের একটি সম্ভাব্য দিগন্ত খুলে দেয়। এখন প্রয়োজন সেই দিগন্তের দিকে হাঁটার সাহস, প্রস্তুতি ও আন্তরিকতা।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক