প্রসঙ্গ : এসএসসির ফল ও জনমনে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন

সম্পাদকীয়

ফাইল ছবি

২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল ১০ জুলাই সারা দেশে একযোগে প্রকাশ করা হয়েছে। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় অপ্রত্যাশিতভাবে কমেছে। দেশের সাধারণ নয়টি বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলে মোট ১৯ লাখ চার হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসলেও জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। যা গত কয়েক বছরের গড় তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। জিপিএ-৫ বিপর্যয়ের পাশাপাশি দুর্গতির ছায়া পড়েছে গড় পাসের হিসাবেও। গত ১৫ বছরের মধ্যে চলতি বছর এই পরীক্ষায় পাসের হার অনেক কমেছে। কেবল গত বছরের তুলনায় এ বছর ১৪.৫৯ শতাংশ কমেছে। সার্বিক ফলাফল কি শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্বলতার ফল, নাকি এটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা ও যোগ্যতার এক বাস্তবসম্মত প্রতিফলন— এমন প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ফলাফল বিশ্লেষণে বোর্ডভিত্তিক বৈষম্য আরও স্পষ্ট। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৭৭.৬৩ শতাংশ, অথচ বরিশালে তা ৫৬.৩৮ শতাংশ। এমনকি রাজধানী ঢাকায়ও তা ৬৭.৫১ শতাংশে ঠেকেছে, যা জাতীয় গড়ের নিচে। শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছরের ৫১ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৪-এ, আর শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যা নেমে এসেছে ৯৮৪-তে। এসব পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, বরং এক একটি ব্যর্থতা, এক একটি অবহেলার চিহ্ন।

চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলের সঙ্গে গত চার বছরের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সাধারণ নয়টি বোর্ড, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মিলে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জনে। ২০২৩ সালে সবগুলো বোর্ড মিলে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জনে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জনে। সবশেষ ২০২৫ সালে সবগুলো বোর্ড মিলে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জনে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এবারই সর্বোচ্চ কম সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।

আরও বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হলো, প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থীর ফেল করা। এদের অনেকেই মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেই ঝরে পড়বে, আর ফিরে আসবে না কোনো দিন। এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে আমরা কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছি? তারা কি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পাবে, নাকি অদক্ষ বেকার হিসেবে সমাজে যুক্ত হবে?

আরেকটি কথা, আমাদের শিক্ষার্থীরা কি তবে মুখস্তভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে আটকে আছে? এমনটি হলে এজন্য শিক্ষকরাও দায়ী। তারা শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে মোটিভেট করতে পারছেন না। ফলে সৃজনশীল চিন্তাধারার যে বিকাশ প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না। শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংকট প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাথমিকের ভিত্তি যদি শক্ত না হয়, তাহলে এসএসসি বা এইচএসসিতে ভালো ফল করা সম্ভব নয়। আর ভালো ফলাফলের জন্য দরকার ভালো শিক্ষক। পাশাপাশি কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরও কার্যকরভাবে পড়ানো যায়, সেই বিষয়েও গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

২০২৫ সালের পাসের হারের এই পতনকে আমরা যদি ‘সতর্কসংকেত’ হিসেবে না নিই, বরং রাজনৈতিক চাপ বা প্রশাসনিক অস্বস্তির চোখে দেখি, তবে শিক্ষার ভবিষ্যৎ আরও ঝুঁকিতে পড়বে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি ফলাফলকে মুখস্থনির্ভরতার ফসল হিসেবে দেখে আত্মতুষ্ট, নাকি শিক্ষার মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবার তাগিদ বোধ করব?

শেয়ার করুন