গোপালগঞ্জ: দাফন-দাহ হয়েছে, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত, মামলা হয়নি

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জে গত বুধবার (১৬ জুলাই) নিহত চারজনের মধ্যে একজন টাইলস মিস্ত্রির সহকারী, একজন দোকান কর্মচারী। বাকি দুইজন ব্যবসায়ী। শহরে তাদের পোশাক ও মোবাইলের দোকান আছে। স্বজন, প্রতিবেশী ও পরিচিতজনের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তিনজন শহরে কাজ থেকে বাসায় ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। একজন ওই দিন কাজে যাননি বলে জানিয়েছেন তাঁর মালিক।

এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। নিহত চারজনেরই মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন ও সৎকার করা হয়েছে। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়নি। হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর স্বজনরা মরদেহ নিয়ে যান। পুলিশ এ ব্যাপারে আইনগত কোনো ভূমিকা রাখেনি। তবে স্থানীয় পুলিশ এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক গতকাল সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আইনি প্রক্রিয়া মেনে মামলা ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা হবে।

গোপালগঞ্জে কিংস পার্টি হিসেবে তকমা পাওয়া নিবন্ধনহীন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পূর্বঘোষিত সমাবেশ ছিল বুধবার দুপুরে। সকালেই ছাত্রলীগ কর্মীরা পুলিশের গাড়িতে আগ্নিসংযোগ এবং ইউএনওর গাড়িতে হামলা করে বলে অভিযোগ উঠে। দুপুরে গোপালগঞ্জের বিক্ষুব্ধ জনতা এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। এরপর সমাবেশ শেষে ফেরার পথে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহরে হামলা করে তারা। তারপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

নিহতরা সবাই বয়সে তরুণ। তারা হলেন- টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজী, ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭), পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা (২৫) ও মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল রানা (৩০)।

গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, চারজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত পুলিশ ময়নাতদন্তের আবেদন জানায়। তবে বুধবার ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ আসেনি বা কিছু বলেনি। তাছাড়া আমরা যে ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেব সেই সুযোগ ছিল না। কারণ নিহতদের স্বজন ছিলেন ক্ষুব্ধ ও উচ্ছৃঙ্খল। তারা ময়নাতদন্ত করাতে রাজি ছিলেন না। তারা বলছিলেন, আমাদের লোক মরে গেছে, ময়নাতদন্ত করে আর কী হবে। এ কারণে ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি।

বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত ১৮ জন গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি ওয়ার্ডের ইনচার্জ তৃপ্তি বিশ্বাস জানান, চিকিৎসা নিয়ে তারা ফিরে গেছেন। কারও আঘাত গুরুতর ছিল না।

বাসায় ফেরার পথে গুলি খান রমজান

নিহত রমজান কাজী (১৭) দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা কামরুল কাজী ভ্যানচালক। মা মর্জিনা বেগম গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। সামান্য আয়ে সংসার চালানো কঠিন। পরিবারকে সহায়তা করতে রমজান টাইলস মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। ইচ্ছা ছিল, টাইলস মিস্ত্রির কাজ শিখে বিদেশে যাবেন। সেখানে ভালো আয় করবেন, তখন মা-বাবাকে আর কষ্ট করতে দেবেন না।

তবে তার আগেই গত বুধবার গোপালগঞ্জ শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

কিশোর রমজান পরিবারের সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরের বিসিকসংলগ্ন মৌলভীপাড়ার ইকবাল মোল্লার বাড়িতে থাকতেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট টিনশেড ঘরে একটি খাট ফেলার পর আর দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। ঘরের ভেতর কম ভোল্টের একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছিল। তাতে খুপরি ঘরটির অন্ধকারও দূর হচ্ছিল না। ঘরের সামনে আত্মীয় ও প্রতিবেশীর ভিড়। তারা সন্তান হারানো মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

রমজানের মা মর্জিনা বেগমের কণ্ঠস্বর শোনাই যাচ্ছিল না প্রায়। বুধবার থেকে কাঁদতে-কাঁদতে তাঁর গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছাওয়াল কোন জাগায় গেল, তোমরা আমার ছাওয়ালকে আইন্যে দেও। রমজান কইছেল, মা আমারে বিদেশে পাঠাও, তোমাগে আর কষ্ট করতে দেব না।’

রমজানের বাবা কামরুল কাজী কিছুটা সামলে উঠেছেন। বিলাপরত স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তিনি। এর ফাঁকে জানালেন, তাঁর তিন ছেলের মধ্যে রমজান ছিল বড়। মেজ ছেলে আলী হাসানের বয়স ১৩ বছর। ছোট ছেলে আবু বক্করের বয়স ৭ বছর।

নিহতের মামা কলিম মুন্সী জানান, অন্যদিনের মতোই কাজের উদ্দেশ্যে সকালে বাসা থেকে বের হন রমজান। শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় কাজ ছিল তাঁর। তবে শহরে ঝামেলা হওয়ার শঙ্কায় তাঁকে তাড়াতাড়ি ছুটি দেন টাইলস মিস্ত্রি। দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে খবর পান আলিয়া মাদ্রাসা এলাকায় আসার পর রমজান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যান এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন।

কলিম মুন্সী বলেন, খবর পেয়ে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যান স্বজনরা। সেখানে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাকে মৃত অবস্থায় পান এবং বাড়িতে নিয়ে আসেন। তার শরীরে বালু-সিমেন্টের গুড়া লেগে ছিল।

কলিম মুন্সী বলেন, পরে মনে হলো এ বিষয়ে পুলিশের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাই ৪টার দিকে রিকশাভ্যানে করে লাশ সদর থানায় নিয়ে যান তারা। তবে সংঘর্ষের পর সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ওই সময় থানার ফটক ছিল বন্ধ। তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর পর তারা ময়নাতদন্ত করানোর জন্য মরদেহ নিয়ে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখান থেকেও তাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে যেতে বলেন। শেষে বুধবার রাতে এশার নামাজের পর পৌর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

মামা কলিম মুন্সী বলেন, ‘সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করছিল রমজান। কোনোদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে ছিল না। মিছিল-মিটিংয়ে যায়নি কখনও। বাসায় ফেরার পথে গুলি খায়।’

রমজান কোথায়, কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন বা কীভাবে মারা গেলেন এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সুরতহাল, ময়নাতদন্ত না হওয়ায় আর বিস্তারিত জানাও সম্ভব হয়নি।

‘সে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছেল না’

১৭ বছর বয়সী আরেক কিশোর ইমন তালুকদার কাজ করত মনোহরপট্টির ক্রোকারিজের দোকানে। পরিবারের সঙ্গে থাকত গোপালগঞ্জ সদরের হরিদাসপুর ইউনিয়নের ভেড়ারবাজার এলাকায়। তার বাবা আজাদ তালুকদারও পেশায় ভ্যানচালক। মা রোকসানা বেগম গৃহিণী।

নিহতের খালাতো ভাই স-মিলের কর্মচারী ইমরান খাঁ জানান, তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল ইমন। দোকানে আসার কথা বলে সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়। পরে দুপুরে সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও দেখে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানতে পারেন তারা।

ইমরান খাঁ বলেন, ‘একটি ভিডিওতে দেখছি, ইমনরে জুতা দিয়ে লাথি মারছে। সে মাফ চাইছিল, ছেড়ে দিতে কচ্ছে। কিন্তু ছাইড়ে দেয়নি।’ পরে তার বড় ভাই জব্বার তালুকদারসহ স্বজনরা হাসপাতালে আসেন। বিকেল সাড়ে ৪টায় তাকে মৃত অবস্থায় পান। তার শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। গতকাল সকালে পৗর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

ভাই ভাই ক্রোকারিজের মালিক মোক্তার মুন্সী বলেন, ‘বছরখানেক ধরে আমার দোকানে কাজ করছে ইমন। তবে বুধবার কাজে আসেনি। দুপুরের পর অনেকের কাছে শুনি সে মইরে গেছে। সে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছেল না।’

দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত গুলিবিদ্ধ হন

সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত দীপ্ত সাহা ছিলেন পোশাক ব্যবসায়ী। শহরের চৌরঙ্গীতে চন্দ্রমুখী গার্মেন্টস নামে দোকানটি চালান তিনি ও তাঁর বড় ভাই সঞ্জয় সাহা শুভ। তাদের বাসা গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন সড়কে।

গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায় শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। সঞ্জয় সাহা বলেন, আমাদের বাবা সন্তোষ সাহা আগেই মারা গেছেন। আমরা দুই ভাই ব্যবসাটি চালাতাম। বুধবার দুপুরে সে দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে মিলন ফার্মেসির সামনে গুলিবিদ্ধ হয়। পেটের বাঁ পাশে গুলি ঢুকে ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। হাসপাতালে গিয়ে তাকে জীবিত পেয়েছিলাম। তবে তাকে বাঁচাতে পারিনি। বুধবার রাতেই পৌর শ্মশানে তার লাশ দাহ করা হয়। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছোট ছিল।

সঞ্জয় সাহার দাবি, দীপ্ত বা তিনি কেউই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তাদের পাশের আরেকটি দোকান ‘ওড়না প্যালেসে’র মালিক কঙ্কন সাহা পার্থ বলেন, রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাঁকে কখনও যেতে দেখিনি। ব্যবসা নিয়েই থাকতেন। শুনেছি, গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে এক সাংবাদিককে ভিডিও করতে দেখে দীপ্ত নাকি বলেছিলেন, আগে নিজের জীবন বাঁচান, পরে ভিডিও কইরেন। এরপরই তাঁর শরীরে গুলি লাগে।

‘পরিস্থিতি দেখতে সামনে এগিয়ে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন’ সোহেল রানা

গোপালগঞ্জ শহরের কেরামত প্লাজায় মোবাইল ফোনের দোকান চালাতেন সোহেল রানা। তাঁর চাচা এম এম কামাল হোসেন জানান, শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সোহেল। বুধবার বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হন। তবে বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকায় তিনি পরিস্থিতি দেখতে সামনে এগিয়ে যান। এর এক পর্যায়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর দুই পা ও পাঁজরে গুলি লেগেছে। পাঁজরের গুলিটি খুব কাছে থেকে করা হয়।

কামাল হোসেনের দাবি, তিনি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁর ভাতিজা সোহেল রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না।

গোপালগঞ্জের আরেক মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী প্লাবন বণিক বলেন, সোহেল ‘আড়াইমো’ নামে একটি ব্রান্ডের ফোনের ডিলার ছিলেন। আমার জানামতে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। ভালো মানুষ ছিলেন।

সোহেল রানা ছিলেন মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবা ইদ্রিস আলী ওরফে ঠান্ডা মোল্লা একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা লাইলী বেগম। তাদের বাড়ি টুঙ্গিপিাড়ার পূর্বপাড়ায় ৩ নম্বর ওয়ার্ডে।

শেয়ার করুন