গত ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্ণ হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থগিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্ণাঢ্য ও ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে শতবর্ষপূর্তি উৎসবের উদ্বোধন করেছে। ১ ডিসেম্বর দুপুরে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে হিসাবে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের ৩০ জুন শত বছর পূর্ণ করেছে। ঢাবি প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাবি শতবর্ষ পালন করছে, কাকতালীয় এ ঘটনা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। শতবর্ষের এ ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকদের মতো ঢাবি প্রতিষ্ঠাকালীন সাহসী প্রাণপুরুষদের- যাঁদের অবদান, ত্যাগ-তিতিক্ষা, মেধা ও শ্রমকে জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে ও করছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলনের পটভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে ব্যক্তিমনের সমন্বয় ঘটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। প্রথম বিশ্বযু্দ্ধের পর থেকে উপমহাদেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের উদারনৈতিক মুক্তচেতনানির্ভর ও সামষ্টিক জ্ঞানানুশীলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ঔপনিবেশিক মানসিকতামুক্ত নতুন শ্রেণি সৃষ্টির পথও প্রশস্ত হয়। সেই পথ ধরেই এই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামেরও সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল।
ঢাবির ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলনের আছে সোনালি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক বিজয়ে ঢাবির ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলন সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছে। ছাত্ররাই ইতিবাচক আন্দোলনের সূচনা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৯০-র গণঅভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রয়েছে ঢাবির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা।
দেশের বহু জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গবেষক ও রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ ছাড়া এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে নিজের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটি তার কাক্সিক্ষত অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাঙ্কিংয়ে ঢাবি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে এবং এটা আমাদের জন্য অবশ্যই স্বস্তিদায়ক খবর নয়। এমতাবস্থায় ঢাবিতে গবেষণার জায়গা আরো বিস্তৃতি করা দরকার এবং একইসঙ্গে সংস্কৃতি চর্চায় দেশের যে প্রতিনিধিত্ব করে- সেটি উত্তরোত্তর আরো বৃদ্ধি পাবে, আমরা সেটা প্রত্যাশা করি। গবেষণার জায়গায় আমাদের বিশ্বমানের দিক থেকে আরো দায়িত্ববোধ থাকা দরকার আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর, যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করে ঢাবি আরও বেশি সুনাম অর্জনের পাশাপাশি হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে।অবশ্য এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কারিকুলাম নির্ধারণ এবং পাঠদানের ক্ষেত্রে বিশ্বমানের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা
সম্পাদক, মত ও পথ।