লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধ করা কি অসম্ভব?

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

সুগন্ধার বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড। সংগৃহীত ছবি

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘What is lotted cannot be blotted’। যার অর্থ, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নৌ-পথগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি দেশের জনগণের কপালের লিখন? যদি তা-ই হয়, তাহলে তা খণ্ডনীয় নয়। কারণ ওই যে, ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন’। আবার এসব দুর্ঘটনাগুলোকে এদেশের প্রেক্ষিতে না দেখে যদি উন্নত দেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে উন্নত দেশে লঞ্চডুবি বা নৌ-দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম; যা আমি জার্মানি, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালোয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে থাকাকালীন ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ-খবর নিয়েও দেখেছি। তাহলে কপালের লিখন কি দেশ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে? নিশ্চয়ই না। এ ক্ষেত্রে মূলত যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে- সার্বিক নৌ-যোগাযোগব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, লঞ্চের ফিটসেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, লঞ্চ চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, জনগণের সচেতনতার অভাব, সঠিকভাবে নৌ-আইন না মানা প্রভৃতি।

লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির ঘটনা এ দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। প্রায় প্রতি বছরই লঞ্চডুবিতে অনেক মানুষ আহত, নিহত বা নিখোঁজ হন। শুরু হয় স্বজন হারানো ব্যক্তিদের আহাজারি। এ নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ হয়। গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় এবং যথারীতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তখন সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, ঘটনার সাথে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাস, হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরেই দেশে যেই ঘটে অন্য একটি বড় ঘটনা তখন চাপা পড়ে যায় লঞ্চডুবি বা নৌ-দুর্ঘটনার ঘটনা। ফলে তখন আর কেউ জানতেও পারে না আগের ওই লঞ্চডুবির পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হয়েছে কি না। কিংবা লঞ্চ ডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ আলোর মুখ দেখেছে কি না। এই হচ্ছে বাস্তবতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, নৌ-পথে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর না করা, লঞ্চ চালকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করার ‘সুযোগ’ পাওয়াসহ লঞ্চে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই যে লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির অন্যতম প্রধান কারণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে, এমভি অভিযান নামে একটি লঞ্চে। এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি প্রাণহানির খবর এসেছে, যা আরো বাড়বে।

পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন দেখা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে ৬৬০টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ। আহত হয়েছেন অসংখ্য। দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ হয়েছেন আরও প্রায় ১ হাজার ৬শ’ জন। ২০১৫ সাল পরবর্তী সময়গুলোতেও দেশে থেমে থাকেনি লঞ্চডুবির ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ আহত-নিহত হওয়া ছাড়াও নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে। বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে অসংখ্য পরিবার। আবার লঞ্চডুবিতে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছে শত শত পরিবার।

দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার নৌ-পথ রয়েছে, যার বেশিরভাগই অরক্ষিত। এসব নৌপথে বৈধভাবে প্রায় ৩ হাজার ছোট-বড় লঞ্চ, জাহাজ চললেও অনুমোদনহীনভাবে চলছে কয়েকগুণ নৌযান। তাছাড়া নৌপথে শৃংখলা বজায় রাখতে যতসংখ্যক নৌ-পুলিশ থাকা প্রয়োজন তা নেই। এসব নৌ-পুলিশকে বিআইডব্লিউটিএ’র কিছু সার্ভে জাহাজ ও স্পিডবোট দেয়া হলেও এসব নৌযানে নৌপথের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক যান।

প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনার ঘটনাসহ হতাহতের ঘটনা ঘটলে তদন্ত্ম কমিটি গঠন করা হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনা রোধে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়। এরপর রহস্যজনক কারণে বিষয়টি আর সামনের দিকে ঠিক ওইভাবে এগোয় না। দেশের কোথাও যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে আর তেমন কিছু একটা হয় না। তখন এসব দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তিও পায় না। অনেক সময় দুর্ঘটনায় জন্য দায়ী ব্যক্তিরা আটক হলেও শেষ পর্যন্ত আইনের ফাকফোঁকরে বা রাজনৈতিক প্রভাবে কিংবা কালো টাকার জোরে কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ছাড় পেয়ে যায়। এরপর আবার দুর্ঘটনা বাড়ে। বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল। স্বজনহারানোদের বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নায় বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তি খুব একটা হয় না, যা দুঃখজনক।

এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চমালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে। বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না। মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে। তাছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউই শেষ পর্যন্ত শাস্তি পায় না। বিদ্যমান আইনে লঞ্চমালিক ও চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা খুবই কঠিন। তাছাড়া এই আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। ফলে এ আইটির পরিবর্তন বা সংশোধন হওয়াটা এখন সময়ের দাবি।

দেশের নৌপথ সমূহে লঞ্চ দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌ দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে সর্তকতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচারসহ নদী বন্দর টার্মিনালে মেগাফোনের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোও জরুরি। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রীবহন রোধ করা, লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদিসহ সার্ভে সনদ অনুযায়ী মাস্টার ও ড্রাইভার যথাযথভাবে আছে কি না নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে এবং ওই লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জামাদি না থাকলে ওই লঞ্চের যাত্রা স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট নৌ-আদালতে মামলা দায়ের করা আবশ্যক। আর নৌ-দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষাপূর্বক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নৌযানগুলোতে দক্ষ, সৎ ও দায়িত্ববান চালক নিযুক্ত করা অতি জরুরি। সেই সাথে নৌ-পথে চলাচলকারী নৌযানে কর্মরত মাস্টার, ড্রাইভার, সুকানী ও আনসারদের জন্য নিয়মিতভাবে নদী বন্দরগুলোতে নৌ-নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মশালার আয়োজন করাও প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন নৌ-পথে নিরাপদে চলাচলের স্বার্থে পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করার দরকার। পাশাপাশি নৌ-পথে শৃংখলা বজায় রাখতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক সৎ, মেধাবী ও দক্ষ নৌ-পুলিশ নিয়োগ দেওয়া।

এসবের পাশপাশি ঈদসহ বিভিন্ন ছুটি ও উৎসবের সময়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন পরিহারের লক্ষ্যে স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিসের সুব্যবস্থা করা আবশ্যক। কোথাও লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে দ্রম্নত উদ্ধারাভিযানের লক্ষ্যে প্রয়োজন আধুনিক জাহাজ, স্পিডবোট ও হেলিকপ্টার। সেই সঙ্গে সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, লঞ্চের ফিটনেস ঠিক আছে কি না নিয়মিতভাবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তদারকি করা আবশ্যক। সর্বোপরি, যাত্রীদেরকেও সতর্ক হতে হবে, তারা যেন কখনোই লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে লঞ্চে না ওঠেন। তাছাড়া দেশের এই বিশাল নৌ-পথে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়। উপরোক্ত বিষয়গুলো সংশিস্নষ্ট সকলে কর্তৃক সুনিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশে লঞ্চ দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ভিজিটিং প্রফেসর, লাইসিয়াম অব দ্যা ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটি, ফিলিপাইন।

শেয়ার করুন