সুগন্ধা নদীতে ‘অভিযান-১০’ লঞ্চটিতে আগুন লাগার কারণ উদঘাটনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, ইঞ্জিন রুমে কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটা কারণ আমরা পেয়েছি। সেটাকে আমরা লিংক আপ করে মূল সিদ্ধান্ত নেব।
তদন্তের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসান আরও বলেন, আমরা লঞ্চটি পরিদর্শন করেছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। যেসব স্থানে লঞ্চটি থেমেছিল, সেখানেও আমরা যাব। জাহাজ চালনার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কর্মীদের খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বলব। লঞ্চের কাগজপত্রও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। এ ছাড়া কী কারণে এ দুর্ঘটনা এবং কারও দায়িত্বে অবহেলা বা ব্যর্থতা আছে কি না, সবকিছু আমরা খতিয়ে দেখব।
এদিকে, লঞ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই ঝালকাঠিতে আগুনে পুড়েছে এমভি অভিযান-১০। যাত্রীরা, চালক ও স্টাফদের বারবার বলার পরও কোনো তোয়াক্কা করেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরং স্বাভাবিকের চেয়েও জোরে চালানো হয়েছিল লঞ্চটি বলেও জানা গেছে।
ঢাকা নদী বন্দরে বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঘাট থেকে ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিকট আওয়াজ করতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লঞ্চের ছাদে থাকা সাইলেন্সার থেকে আগুনের ফুলকি উঠতেও দেখা গেছে। মাঝ নদীতে অন্তত ৪ বার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় অথবা বন্ধ করতে বাধ্য হন চালক।
হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া এক যাত্রী বলেন, কিছুক্ষণ পর পর জোরে শব্দ হচ্ছিল ইঞ্জিন থেকে, বন্ধ করে রাখাও হয় বেশ কয়েকবার। হঠাৎ দেখি আগুন, নদীতে যেমন তুফান উঠে তেমনি আগুন দেখতে পাই। সমস্ত লঞ্চে চোখের পলক পড়ার মতো সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া আরও যাত্রীরা জানান, সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের পর বৃহস্পতিবার রাতের লঞ্চ হওয়ায় যাত্রীর চাপ ছিল বেশি। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসার পর চাঁদপুর, বরিশালসহ অন্তত ৩ জায়গায় যাত্রী তোলা হয়েছে। এরপরেও লঞ্চ ঝালকাঠির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগেই। অস্বাভাবিক ছিল লঞ্চের গতিবেগ।
আরেকযাত্রী বলেন, দুই থেকে তিন বার লঞ্চ বন্ধ হয়ে যায়। দুই পা পুড়ে যাওয়ার পর নদীতে লাফ দিয়েছি।
এক নারী যাত্রী বলেন, লঞ্চটা অনেক দ্রুত চলছিল। কেবিনের কেউ বুঝতেই পারেনি। সামনের গেটগুলো বন্ধ ছিল। যখন ইঞ্জিনটা বিস্ফোরণ হয় তখন কিন্তু তারা পারত লঞ্চটা তীরে আনতে।
নিজেরা প্রাণে বাঁচলেও স্বজন হারানো এসব মানুষ বলছেন, ইঞ্জিন রুমে আগুন পুরোদমে লেগে যাবার পরেও ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মাঝ নদীতে চলেছে লঞ্চ। এই সময় চর বা তীরের কাছে কোথাও নোঙর করলে প্রাণে বেঁচে যেতেন যাত্রীদের অনেকেই। লঞ্চের কেউ এগিয়ে আসেননি যাত্রীদের বাঁচাতে।
লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না জানিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছেন সুজনের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম। বলেন, লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। শুধু তদন্ত করলে চলবে না, এর আগেও আমরা বহু দুর্ঘটনার তদন্ত করতে দেখেছি, কাজের কাজ হয়নি।
ঘটনার পর থেকেই লঞ্চের মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ঘটনায় লঞ্চ চালক ও স্টাফদের দুষছেন সে রাতের মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসারা। লঞ্চে আগুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি
লঞ্চে আগুনের ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে ঝালকাঠি সদর থানায়। এ ঘটনায় গঠিত তিনটি কমিটি গতকাল-শনিবার থেকেই তদন্তকাজ শুরু করেছে। শনিবার কমিটির সদস্যরা ঝালকাঠিতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া এবং ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আলমের নেতৃত্বে এই তিন কমিটি তদন্ত শুরু করেন। এ সময় তারা লঞ্চটির বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শী ও যাত্রীদের সহায়তাকারীদের সঙ্গে কথা বলেন।
৫১ নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা
ঝালকাঠি রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৫১ নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ঝালকাঠি যুব রেড ক্রিসেন্টের সভাপতি মো. শাহিন বলেন, আমরা লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের স্বজনদের তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছি। গোয়েন্দা বিভাগ আমাদের কাছ থেকে এ তালিকা নিয়ে যাচাই-বাছাই করছে।