করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ৫ মাসে দেশে বৈদেশিক সহায়তায় ঋণছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে। এরই মধ্যে ছাড় করা হয়েছে ৩০৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২৬ হাজার ২৬০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে)। একই সময়ে ঋণসহায়তায় বিশ্বব্যাংকে ছাড়িয়ে গেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান, রাশিয়া ও চীন। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় শীর্ষে থাকা সংস্থা বিশ্বব্যাংক এখন পঞ্চম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ডিসেম্বরের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থছাড় করেছিল মাত্র ২০৭ কোটি ডলার। ফলে একই সময়ে বছরের ব্যবধানে ১০২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বেশি ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা।
এই অর্থছাড়ে এগিয়ে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি ঋণছাড় করেছে ১৪৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এরপরই জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অবস্থান। এই সময়ে সংস্থাটি অর্থছাড় করেছে ৪৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। জাপানের পরে ঋণছাড়ে এগিয়ে চীন। একই সময়ে দেশটি ৩৮ কোটি ডলার অর্থছাড় করেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে রাশিয়া। তারা ২৮ দশমিক ৮৪ কোটি ডলার ছাড় করেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) সব সময় ঋণছাড়ে এক নম্বরে থাকলেও এবার পাঁচ নম্বরে নেমে এসেছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, পাঁচ মাসে ভারত ৪ দশমিক ৭৬ কোটি ডলার ছাড় করেছে। একই সময়ে চীনের নেতৃত্বাধীন এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ছাড় করেছে ৬ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত পাঁচ মাসে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে মোট প্রতিশ্রুতি ছিল ৩৯৩ কোটি ডলারের। সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি ছিল চীনের কাছে ১১২ দশমিক ৭ কোটি ডলার। এর পরেই এডিবির কাছ থেকে ৮০ কোটি ডলার। ঋণ প্রতিশ্রুতির তালিকায় ছিল এআইআইবির ৫১ কোটি, জাপানের ৩৫ কোটি এবং বিশ্বব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার। অর্থছাড় করলেও ভারত ও রাশিয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না।
গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড়ে এগিয়ে ছিল জাপান ও আমেরিকা। দেশ দুটি ৭১ কোটি ডলার অর্থছাড় করেছিল। এরপরই অর্থছাড় করেছিল বিশ্বব্যাংক ৪১, এডিবি ৩০, ইউরোপ ২০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে চীনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থছাড় না থাকলেও দেশটি এখন অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠছে।
গত বছর একই সময়ে ঋণের অর্থছাড় হয়েছিল ১৭১ কোটি ডলার (১৪ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা)। সেই হিসাবে ঋণছাড় বেড়েছে সাত হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের দাবি, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার অর্থায়নে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি ভালো বলেই বেড়েছে অর্থছাড়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণকাজ চলমান। এর প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহায়তা ৪ হাজার ৪৬১ দশমিক ২৩ কোটি টাকা এবং চীন সরকারের অর্থ সহায়তা ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা। চীনের অর্থায়নে পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ ও পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এই প্রকল্পে ২১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ঋণ দেবে চীন।
এছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্পে বড় ঋণ দিচ্ছে জাপান। পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পও চলমান। এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো হয়নি। এসব কারণে মূলত এক নম্বর থেকে অর্থছাড়ে পাঁচ নম্বরে নেমে এসেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে অর্থছাড়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো নয়। ফলে বিশ্বব্যাংকের অর্থছাড় অন্য উন্নয়ন সহযোগীর চেয়ে কমেছে।
চীন-রাশিয়ার অর্থছাড় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীন ও রাশিয়ার অর্থায়নে কিছু বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। যেমন- চীনের অর্থায়নে পদ্মা সেতু রেললিংক ও কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে অর্থছাড় হলে পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, যা অন্য একাধিক প্রকল্পে অর্থছাড় হলেও এসব মেগা প্রকল্পের সমান হবে না।