রাষ্ট্রে সর্বজনীন কল্যাণ গুরুত্ব পাচ্ছে না

আবুল কাসেম ফজলুল হক

আবুল কাসেম ফজলুল হক
আবুল কাসেম ফজলুল হক

পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় কী—এই প্রশ্ন যুগে যুগে মানুষের মনকে আলোড়িত করেছে। এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়েই মানুষ উদ্ভাবন করেছে আদর্শ, জীবনদর্শন, কর্মনীতি, কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি। ধর্মের মধ্যেও আমরা এই প্রশ্নের উত্তর পাই—সেই উত্তর গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক। সমাজে দুর্বল, শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দাবি কখনো কখনো প্রবল হয়ে ওঠে। ধর্ম প্রবর্তক ও আদর্শ প্রতিষ্ঠাতারা আত্মপ্রকাশ করেন সেই মুক্তির ঘোষণা নিয়ে।

ধর্ম প্রচারকরা ও ধার্মিক লোকেরা বলে থাকেন ধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত। ধর্মের বিধি-বিধান, রীতি-নীতি ও প্রথা-পদ্ধতি ঈশ্বর কর্তৃক ধর্ম প্রবর্তকদের কাছে মানুষের জন্য অলৌকিক উপায়ে প্রদত্ত। ঈশ্বর সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। আবার নিরীশ্বর ধর্মও আছে; যেমন—বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম। তবে এগুলোতেও প্রচুর অলৌকিক উপাদান আছে।

যাঁরা সেক্যুলার, ইহবাদী—তাঁরা ধর্মের অলৌকিক বিষয়াদি পরিহার করে শুধু জাগতিক বিষয়াদিকে বিবেচনায় ধরেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন নীতি ও আদর্শ উদ্ভাবন করেন। ধর্মগ্রন্থ ও ধর্ম প্রচারকদের নির্দেশ পরিহার করে তাঁরা মানুষের সৃষ্ট নীতি-বিধি দ্বারা পরিচালিত হন। তাঁরা আইনসভায় সৃষ্ট আইন অবলম্বন করেন। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম নিয়ে চিন্তা কমই দেখা গেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে গোঁড়া নাস্তিক ও গোঁড়া ধর্মবিরোধী লোক কিছু দেখা গেছে। তাঁদের গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র নিয়ে যুক্তিবুদ্ধি অবলম্বন করে কাজ করতে বিশেষ দেখা যায়নি। নানা রকম উগ্রতা দেখা গেছে। নাস্তিকতা প্রচার এবং ধর্মবিরোধী উগ্র প্রচার-প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় শক্তির ও পরিত্যক্ত পুরনো সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। দুর্নীতি প্রবল রূপ নিয়ে আছে। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের অনুশীলন না থাকার ফলে রাজনীতিতে ধর্মীয় যৌক্তিক শক্তিকে প্রবল হতে দেখা যাচ্ছে।

এ দেশে সেক্যুলারিজমের উপলব্ধি খুব কম লোকের মধ্যেই দেখা গেছে। মৌলবাদবিরোধী প্রচার-আন্দোলন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কিংবা অসাম্প্রদায়িকতার কার্যক্রম গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে পরিহার করে অগ্রসর হতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। আন্তরিকতা ও সততার অনুশীলন না থাকার ফলে ভণ্ডামি ও ভাঁওতা-প্রতারণা বেড়ে চলছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ দুনিয়াটাকে পরিচালনা করছে সভ্যতাবিরোধী সংস্কৃতিবিরোধী ধারায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার হারানো প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। রাশিয়া ও চীন চলছে শুধু তাদের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে। গোটা মানবজাতি নিয়ে চিন্তা করার মতো সভ্যতার ধারায়, সংস্কৃতির ধারায়, প্রগতির ধারায় চিন্তা ও কাজ করার মাতো রাজনীতিবিদ কিংবা দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক, শিল্পী-সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যায় না।

সাধারণ মানুষের ঘুমন্ত একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় যাচ্ছে। দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য কালজয়ী নতুন চিন্তা ও কাজের ধারা দরকার। যাক আগের কথায় ফিরে আসি। নীতি ও আইনের উৎস ধর্ম বা ঈশ্বর—এ ধারণাও প্রচলিত আছে। তবে পূর্বধারণামুক্ত তথ্যভিত্তিক, বাস্তবসম্মত চিন্তা এবং নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস প্রমাণ করে যে নৈতিক চেতনাই ধর্মের উৎস। ধর্মে নীতি আছে, কিন্তু ধর্ম নৈতিক চেতনার উৎস নয়। নীতি ও আইনের উৎস ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত নৈতিক চেতনা। প্রতিটি ধর্মেই মানুষের জন্য আইন ও নীতি আছে, জীবনযাত্রা প্রণালী নির্দেশিত আছে। নৈতিক চেতনা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, নিতান্তই মানবিক ব্যাপার। মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত মনোদৈহিক ও পরিবেশগত ব্যাপার।

উন্নততর নতুন পৃথিবী সৃষ্টির জন্য নৈতিক চেতনার স্বরূপ বোঝা একান্ত দরকার। আস্তিক, নাস্তিক সব মানুষের মধ্যেই নৈতিক চেতনা আছে। আদিম মানুষের মধ্যেও নৈতিক চেতনা ছিল। মানুষের সত্তা থেকে নেতিক চেতনা কি উবে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে গোটা জাতির মধ্যে এ বিষয়ে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপলব্ধি ও জ্ঞান না থাকার ফলে শিশু-কিশোরদের জন্য বই পাঠ্য আছে ইসলাম ও নীতিশিক্ষা, হিন্দু ধর্ম ও নীতিশিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্ম ও নীতিশিক্ষা, খ্রিস্ট ধর্ম ও নীতিশিক্ষা। যাঁরা এগুলো প্রবর্তন করেছেন তাঁরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ বলতে বলতে সবাইকে ক্লান্ত করে ফেলছেন। আগে উল্লেখ করেছি, আমরা সেক্যুলারিজমের প্রতিষ্ঠা চাই। সেই সঙ্গে চাই ‘সর্বজনীন গণতন্ত্র’। সর্বজনীন গণতন্ত্র আমাদের উদ্ভাবন করে নিতে হবে। তার জন্য নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান দরকার। বাংলাদেশে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছেন, তাঁদের প্রচারকার্যের দ্বারা ধর্মীয় শক্তি উসকানি পাচ্ছে এবং অধিকতর সক্রিয় হচ্ছে। আশা করি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা এবং অসাম্প্রদায়িকতাবাদীরা এ বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

ধর্মে যেসব অলৌকিক ব্যাপার আছে, যেমন—দৈবত্ব, অবতারত্ব, নবুয়ত, রিসালাত, ওহি, মিরাজ, দিব্যজ্ঞান, ঈশ্বর, দেবতা, জন্মান্তর, নির্বাণ, জাতিস্মরতা, কিয়ামত, আখিরাত, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, বেহেশত, দোজখ, স্বর্গ, নরক, ধর্মগ্রন্থের অপৌরুষেয়তা ইত্যাদি। এগুলো বিশ্বাসের ব্যাপার, যুক্তিতর্কে বা প্রমাণে এগুলো পাওয়া যায় না, বিজ্ঞান এগুলো সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। অনেকে বিশ্বাস নিয়ে চলেন, অনেকে যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছেন। উন্নততর বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে প্রতিটি রাষ্ট্রেই বিভিন্ন বিশ্বাসের লোকদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও প্রগতির পথ ধরে চলতে হবে। বিশ্বাসের প্রশ্নে চাপ সৃষ্টি ও জুলুম-জবরদস্তি বন্ধ করতে হবে। চাপ সৃষ্টি ও জুলুম-জবরদস্তির কারণে বাংলাদেশে গত চার দশকের মধ্যে অসহিষ্ণু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বেড়ে গেছে, গণতন্ত্রের বাস্তবতা বিনষ্ট হয়েছে।

বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ আছে। তবে বিজ্ঞানের আবিষ্কার-উদ্ভাবনকে সব ধর্মের লোকই শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবনযাত্রার ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে গ্রহণ করে নেয়। বিশ্বাসের সঙ্গে স্বার্থ যুক্ত থাকে বলে বিরোধ জটিল রূপ নেয়।

ইসলাম শান্তির ধর্ম এটাই বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। জিহাদি কথাটিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে শান্তির সূত্র ধরে। কিন্তু চার দশক ধরে ইসলামের জঙ্গিবাদি ব্যাখ্যা নিয়ে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি সংগঠনের যে কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে, সেগুলো কি ইসলামসম্মত? এ প্রশ্নেরও উত্তর সন্ধান দরকার। আমরা স্বাধীন চিন্তাশীলতা চাই। ধর্মান্ধ, মতান্ধ চিন্তা ও কাজ কল্যাণকর নয়।

বাংলাদেশে ধর্ষণ ব্যাপারটির যে ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে, তার পরিণতি কী হবে? ব্যাপারটিকে কি গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নিচ্ছে? গোটা সমাজ মেনে নিচ্ছে? আইন ও বিধি-ব্যবস্থা ধর্ষণের অনুকূল নয়, প্রতিকূল? আইন-আদালত আছে, শাস্তির ব্যবস্থাও আছে। ব্যাপারটি কি এখন শুধু পুলিশ আর আইন-আদালত দিয়ে সমাধান করার পর্যায়ে আছে? পরিবারের অবস্থা কী? এসংক্রান্ত প্রচলিত আইন-কানুনের সংস্কার কী অপরিহার্য নয়?

বাংলাদেশে আজ রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের বিভিন্ন গ্রুপের নৈতিক চেতনা ও শ্রেয়োবোধ কি যথেষ্ট শক্তিশালী? কায়েমি-স্বার্থবাদী বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের অনুসারীরা জনসাধারণের, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের, শিক্ষিত নাগরিকদের ও ছাত্র-তরুণদের নৈতিক জাগরণকে খুব ভয় পায়। এ জন্য তারা এমন সব ব্যবস্থা করে রাখে, যাতে সবাই দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়, আর অদৃষ্টবাদ সৃষ্টির অনুকূল হয়। প্রচারমাধ্যমগুলোর ভূমিকা জনমনে অদৃষ্টবাদ সৃষ্টির অনুকূলে। এই বাস্তবতাকে অতিক্রম করার জন্য দরকার জনসাধারণের নৈতিক চেতনার জাগরণ, নৈতিক আন্দোলন ও সংঘবব্ধ সংগ্রাম। নৈতিক আন্দোলনকে অবশ্যই অবিচ্ছেদ্যরূপে যুক্ত থাকতে হবে জনগণের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতির কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। রাজনৈতিক আয়োজন লাগবে, অরাজনৈতিক আয়োজন নিয়ে অল্পই এগোনো যাবে।

ইউরোপে রেনেসাঁস ও শিল্প বিপ্লবের ধারায় উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে উদ্ভূত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মতাদর্শ মার্ক্সবাদ বিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে শাসক-শোষকদের স্বার্থে গণতন্ত্রকেও পরিণত করা হয়েছে জনগণের কাছে অনাকর্ষণীয় এক বক্তব্যে। মতাদর্শগত দিক দিয়ে মানবজাতি এখন এক ভাঁওতা-প্রতারণার কাল অতিক্রম করছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে প্রচলিত আদর্শের সংস্কারের ও নবায়নের কিংবা নতুন আদর্শ উদ্ভাবনের পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ধর্মের পুনরুজ্জীবন।

ভাঁওতা-প্রতারণা নিয়ে কল্পনা ও আদর্শ ছাড়াই কি মানিবজাতি চলবে? মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের প্রবক্তারা আর উত্তরাধুনিকবাদীরা আদর্শের প্রয়োজন অস্বীকার করেন। তাঁদের চিন্তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মের ও পুরনো সংস্কার বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করছে। যাঁরা শক্তিমান, প্রবল, সম্পত্তিশালী তাঁরা ধর্ম ছাড়াও চলতে পারেন। তবে তাঁরা রাজনীতিতে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমান দার্শনিক সেনেকা লিখেছিলেন, ‘Religion is regarded by the common people true, by the wise as false and by the rulars as useful’.

তিনি ধর্মের অলৌকিক বিষয়গুলোর কথাই বলেছিলেন।

দুর্বল, নির্যাতিত, গরিব মানুষকে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রসারের জন্য দরকার অনুকূল আদর্শ, নীতি, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কার্যক্রম। দরকার নেতৃত্ব। নেতৃত্ব গড়ে ওঠে রাজনৈতিক দল অবলম্বন করে। দল শুধু নেতাকর্মীদের ব্যাপার নয়, জনসাধারণেরও ব্যাপার। জনগণ ঘুমিয়ে থাকলে সর্বজনীন গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সম্ভব হয় না। গোটা মানবজাতির জন্যই সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে এই কালটা সংকট অতিক্রম করার কাল। উৎপাদন ও সম্পদ বাড়ছে। কিন্তু মানবতার দিক দিয়ে ব্যক্তি, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা নিম্নগামী।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি সংস্কৃতি, উন্নয়ন, রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রচার করে একটি ভাবাবর্ত তৈরি করেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে, ক্ষমতার অনুকূলে নানা কিছুর সঙ্গে ভাবাবর্তও দরকার হয়। আওয়ামী লীগ সৃষ্ট এই ভাবাবর্তের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে ভারতবিদ্বেষ, মার্কিন শক্তির প্রতি অনুরাগ ও রাজনৈতিক ইসলামের পুনরুজ্জীবন। আওয়ামী লীগ সৃষ্ট ভাবাবর্তের পাশে প্রকৃতপক্ষে অন্য কোনো ভাবাবর্ত গড়ে উঠছে না। ধর্মের আবেদন আছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দল যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করছে, তাতে কোনো বর্ধিষ্ণু ধর্মীয় ভাবাবর্ত তৈরি হচ্ছে না। আমার ধারণা, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী কোনো শক্তি গড়ে উঠতে পারবে না। তবে আওয়ামী লীগ যেভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে, তা-ও জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। বিএনপির এমন কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই, যাতে জনগণ আকর্ষণ বোধ করতে পারে। তবে জনগণের ওপর জুলুম-জবরদস্তির কারণে শাসকদলের প্রতি জনগণের বিরূপতা বাড়ছে। যে অবস্থা চলছে তাতে দিন দিন গণতন্ত্রের প্রতি, রাজনীতির প্রতিও জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে। দেশপ্রেমের তুলনায় আত্মপ্রেম এত প্রবল যে এ রাষ্ট্রে সর্বজনীন কল্যাণ গুরুত্ব পাচ্ছে না।

দরকার সর্বজনীন কল্যাণে জনগণের (Government of the people, by the people, for the people) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সরকার। সেদিকে এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি দলের কোনো আগ্রহই নেই। উন্নতিশীল রাজনৈতিক দল ছাড়া রাষ্ট্র গড়ে ওঠে না। জনগণের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠন ও তার আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের প্রতিই এখন কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া দরকার। দল গঠন না করে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ দল গঠনের চিন্তায় ও কাজে মনোযোগী না হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। রাজনীতিকে স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল রূপ দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া, জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সরকার ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচার দ্বারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। রাজনীতির নামে নিঃরাজনীতিকরণের কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা দরকার। দরকার নতুন বৌদ্ধিক আন্দোলন ও নতুন গণজাগরণ।

লেখক : রাষ্ট্রচিন্তক, আহমদ শরীফ
চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন