১১২ বছর আগে (১৩১৬ সালে) রচিত রবীন্দ্র পঙিত ‘ভরা গৃহে শূন্য আমি/তোমা বিহনে’। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি আমাদের যে শূন্যতায় মুহ্যমান রাখে এবং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত—তারই প্রকাশ শিরোনামে উদ্ধৃত এই রবীন্দ্র পঙিত। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা ও সাফল্যের এক চূড়ায় ওঠার দিন। আর বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে বাঙালি জাতির জন্য দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ২৫ দিন পর আরেকটি মহান বিজয়। বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষ সেদিন আনন্দে, উচ্ছ্বাসে, উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সোমবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মাস ১৪ দিন পাকিস্তানে বন্দিজীবনের পর স্বাধীন, মুক্ত বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময় থেকে বাঙালি জাতি প্রতিবছর এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। এবার বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। একই সঙ্গে সংকল্পবদ্ধ হই যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাব।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডন পৌঁছেন। ওই দিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে টেলিফোন করে প্রথমেই জানতে চান, ‘দেশবাসী কেমন আছে?’ পরদিন ৯ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল—‘হ্যালো তাজউদ্দীন, দেশবাসী কেমন আছে’ শীর্ষক শিরোনামে। বঙ্গবন্ধুর এই জিজ্ঞাসা জনগণের প্রতি তাঁর ভালোবাসার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লন্ডনে ৯ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু সেদিন লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনে যান এবং প্রায় এক ঘণ্টা দুই নেতা বিভিন্ন বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে কথা বলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তদানীন্তন বিরোধী দলের নেতা মিস্টার হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্ল্যারিজেস হোটেলে সাক্ষাৎ করেন ও উষ্ণ অভিনন্দন জানান।
ঢাকায় ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতি করেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু যেদিন লন্ডন পৌঁছেন, সেদিন সন্ধ্যায় ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন ও কুশলাদি জানতে চান। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। পরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত সময় সকাল সাড়ে ৮টায় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ এবং জনগণ বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিপুল অভ্যর্থনা জানান।
ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। জবাবে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরাই আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ আপনি আপনার দেশবাসীকে স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুজিবের দেহকে বন্দি রেখেছিল পাকিস্তানিরা, কিন্তু তাঁর আত্মাকে বন্দি রাখতে পারেনি, তাঁর আদর্শকে বন্দি রাখতে পারেনি।’ তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যথার্থই জাতির জনক।’ বিমানবন্দরের সন্নিকটে প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা করছি।’ লক্ষণীয় বিষয়, স্বাধীন দেশে ফেরার ক্ষণটিকেই বঙ্গবন্ধু আলোর পথে যাত্রা বলে অভিহিত করেছিলেন।
পাকিস্তানিদের মিথ্যাচার একটি স্বাভাবিক ঘটনা। একাত্তরে বাঙালি গণহত্যার ৫০ বছর পরও তারা যেভাবে মিথ্যাচার করছে, ঠিক তেমনি তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় লন্ডন গমনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।’ অথচ লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু জানান, তাঁকে ব্রিটিশ রাজধানীতে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তেই পাঠানো হয়েছে। শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম। পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমার ইচ্ছামতো নয়।’ বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে বেগম মুজিব ও ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে টেলিফোনে কুশল বিনিময় করেন, যা ছিল অত্যন্ত আবেগময়। অধুনালুপ্ত আজাদ পত্রিকা সেদিনের এই খবরটির শিরোনাম দিয়েছিল, ‘একটি কণ্ঠ : কয়েকটি মুহূর্ত, কিছু আবেগ—অনেক কান্না’। আজাদ পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের ফোনালাপের সংবাদ প্রকাশ করেছিল ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি সংখ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বলেছিলেন, ‘সোমবার হবে জাতির জীবনে সর্বাপেক্ষা আনন্দের দিন।’ তিনি দিনটিকে জাতীয় ছুটি ঘোষণাকালে স্মিতহাস্যে বলেন, ‘সম্ভবত কেউ আনুষ্ঠানিক ছুটি ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করবেন না।’
১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বিজয় অর্জন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি এই ২৫ দিন দেশের মানুষ যে কী ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে অতিবাহিত করে তা আজ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর নিজ দেশে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের জন্য বিভিন্ন ধর্মের মানুষ প্রার্থনা করেছে, রোজা পালন করেছে, উপবাস করেছে, কান্নাকাটি করেছে—এসব ছিল সেই সময়কার সাধারণ চিত্র।
মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণ ছিল জাতীয় বীরের বেশে। যে কথা তিনি বলেছিলেন ৭ই মার্চের ভাষণে ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। মৃত্যুভয়কে এড়িয়ে সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি উন্নীত হয়েছিলেন জাতীয় বীরে। বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি হয়ে ওঠে অন্তর্লীন সত্তা। সে কারণে তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল বিশ্বরাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষের অভিবাদন তিনি পাবেন সর্বদা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এক সাংবাদিক জাতির উদ্দেশে তাঁর কোনো বাণী আছে কি না জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু স্মিতহাস্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই ওরে ক্ষয় নাই’—পঙিতগুচ্ছ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আজকের দিনে জাতির প্রতি এটিই আমার বক্তব্য।’
বঙ্গবন্ধু সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তাদের কারাগারে আবদ্ধ থাকলেও বাংলার মানুষ তাঁকে এক মুহূর্তের জন্য ভোলেনি। তাঁর নাম নিয়ে মানুষ যুদ্ধ করেছে, বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং পাকিস্তান বাহিনীর সব হিংস্রতা ও বর্বরতাকে মোকাবেলা করেছে। যুদ্ধের ৯ মাস মানুষ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়েই যুদ্ধ করেছে। এটিই ছিল বাঙালির রণধ্বনি বা যুদ্ধনিনাদ। তাঁকে নেতৃত্বের আসনে রেখে, তাঁরই সাহসী চেতনা থেকে সাহস সঞ্চয় করে মুক্তিযুদ্ধসহ সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে দেশের মানুষ। তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। যুদ্ধের ৯ মাস নেতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংসার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে জাতীয় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এভাবে জনগণ এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের অকুণ্ঠ আস্থা, ভরসা ও ভালোবাসা অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ফলে বিশ্বজনমতের চাপেই পাকিস্তানিরা তাঁকে ফাঁসি দিতে পারেনি।
আমরা সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা সংবাদ পাই ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি। সেদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন যে তাঁকে শিগগিরই মুক্তি দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে করাচিতে এক জনসভায় ভুট্টো জনমত যাচাইয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে জনগণের সমর্থন আছে কি না তা জানানোর জন্য হাত তোলার আহ্বান জানান। সভায় উপস্থিত প্রতিটি মানুষ দুই হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে সমর্থন দেয়। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের হোক, পাকিস্তানের হোক, যেকোনো জায়গারই হোক, বঙ্গবন্ধু সব বঞ্চিত মানুষের কাছে ছিলেন প্রিয় মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমগ্র জাতির জন্য গভীর শিক্ষণীয় একটি দিক। এই দিনে বাঙালির এই প্রত্যয় হোক, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়নে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেভাবে এগিয়ে চলেছেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষ তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। কারণ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এসেই বলেছিলেন, ‘আমি ৭ই মার্চে যেমন বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আজকে আপনাদের প্রতি একইভাবে আহ্বান জানাচ্ছি, স্বাধীনতাকে সুসংহত রাখার জন্য আপনাদের সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ তাই আজকে সময় এসেছে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরের সর্বোত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়