ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনী প্রতীক ‘হাতপাখা’ ক্রমেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে (নাসিক) ‘তৃতীয় শক্তি’ হয়ে উঠছে। ধর্মপন্থি আরেক উগ্র সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ‘নিরব ভোট ব্যাংক’ আছে নাসিক এলাকায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বেকায়কায় থাকা জামায়াতেরও তলে তলে সেখানে ‘শক্তিশালী’ অবস্থান। নাসিকের এবারের নির্বাচন সামনে রেখে গত কয়েকদিন ধরে চলা এসব হিসাব-নিকাশের তেমন প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি ভোটের বাক্সে।
নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিকে কীভাবে দেখছেন, এ বার্তা দিয়েছেন রোববার অনুষ্ঠিত নাসিকের ভোটে। ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো এবারও ভোটের মাঠে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তাদের ভোট সেভাবে বাড়ছে না, যেন নির্দিষ্ট সংখ্যায় আটকে আছে। এবারও ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নিজের বাক্সে ভোট বেশি টানতে পারেনি। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থাকায় গত প্রায় এক বছর ধরে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর নারায়ণগঞ্জে তৎপরতা ছিল কম। সহিংসতার মামলায় উগ্রপন্থি সংগঠনের নেতাকর্মীরা কারাগারে ও আত্মগোপনে থাকায় নির্বাচনের মাঠে তাদেরকে তেমন দেখা যায়নি।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা আগেই ধারণা করেন, এবার ২০ থেকে ২৫ হাজার ভোট পেতে পারে হাতপাখা। ‘হাতপাখা তৃতীয় শক্তি’- এর বিজ্ঞাপনও দেয় নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিনের শোডাউনে। গত শুক্রবার নগরের চাষাঢ়ায় হাতপাখার মিছিলের অবয়ব আর লোকবলের উপস্থিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা ছিল। এবার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ৭০ হাজারের মতো ভোট পাবেন বলে ‘ইঙ্গিত ও দাবি’ ছিল চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের ‘হাতপাখার’ মেয়র প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহর। তার দাবি শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়নি।
২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নাসিকের দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রায় ১৪ হাজার বা ৫ শতাংশ ভোট পান তিনি। নৌকা নিয়ে প্রায় পৌনে দুই লাখ ভোট পেয়ে ওই বছর মেয়র নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং ধানের শীষ নিয়ে ৯৬ হাজার ভোট পাওয়া বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খানের পরে ছিল তার অবস্থান।
রোববার অনুষ্ঠিত ভোটের ১৯২টি কেন্দ্রের ফল বেসরকারিভাবে রাতে পাওয়া গেছে। এতে সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন এক লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ ভোট আর স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ‘হাতি’ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। মাছুম বিল্লাহ পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৮৭ ভোট।
মাস ছয়েক আগে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া খেলাফত মজলিসের দেয়ালঘড়ি প্রতীকে মেয়র প্রার্থী হন সিরাজুল মামুন। দেয়ালঘড়ি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পাবে- এমন সম্ভাবনা একেবারেই কম ছিল। হয়েছেও তাই। দলটির প্রার্থী এবিএম সিরাজুল মামুন পেয়েছেন ১০ হাজার ৭২৪ ভোট।
গত মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। একাদশ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষে শামীম ওসমানের বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মনির হোসেন কাসেমী। সহিংসতার মামলায় তিনিসহ হেফাজতের অধিকাংশ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় এবং কমিটি বিলুপ্ত করায় সংগঠনটির চোখে পড়ার মতো তৎপরতা ছিল না নাসিক নির্বাচনে।
নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নারায়ণগঞ্জের ভোটের রাজনীতিতে আসলে কখনোই শক্ত অবস্থান ছিল না। এবারের নির্বাচনে তাদেরও তৎপরতা ছিল না। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজত সমর্থক ও জামায়াতের হাতেগোণা ভোট কোন দিকে যায়, ভোটের আগে তা স্পষ্ট না হলেও নৌকায় যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ ছিল শুরু থেকেই।
নির্বাচনে মূল লড়াইটা হবে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ‘নৌকা’ ও তৈমূর আলম খন্দকারের ‘হাতি’ প্রতীকের মধ্যে- এটা অনুমিত ছিল। দুই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতীক ভোটের হিসাবে প্রথম ও দ্বিতীয় হলে তৃতীয় অবস্থানে কোন দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রতীক থাকছে- এ বিষয়ে গত কয়েক দিন ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছিল।
নাসিকের আগের নির্বাচনে ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের লাগোয়া কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাব কষে তৃতীয় অবস্থানে ঠাঁই দেওয়া হয় ‘হাতপাখা’কে। রোববার ভোট গণনার পর দেখা যাচ্ছে- মেয়র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে হাতপাখা তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা প্রতীকের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান অনেক।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ২০-দলের ‘অন্যতম শরিক’ ছিল খেলাফত মজলিস। গত বছরের ১ অক্টোবর দলটি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। এর ‘প্রতিক্রিয়ায়’ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ‘সরকারের চাপেই খেলাফত মজলিস বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছেড়েছে।’ তবে জোট ছাড়ার কারণ হিসেবে খেলাফত ‘২০১৯ সাল থেকে জোটের দৃশ্যমান তৎপরতা ও কর্মসূচি না থাকা এবং ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০-দলীয় জোটকে অকার্যকর করার’ অভিযোগ করে।
খেলাফত মজলিস ছিল ২০-দলীয় জোটে থাকা একমাত্র নিবন্ধিত ধর্মপন্থি দল। এর বাইরে যে কয়টি ইসলামি দল জোটে আছে, সেগুলো মূলত এর আগে বেরিয়ে যাওয়া দলগুলোর খণ্ডিত অংশ। এর মধ্যে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মনসুরুল হাসান) আরেকটি অংশ ২০-দলীয় জোটে থাকলেও তাদের নিবন্ধন নেই।
১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। এখন সেই জোটের শরিকদের মধ্যে জামায়াত ছাড়া আর কোনো দল নেই। ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট আগেই জোট ছাড়ে। গত বছরের ১৪ জুলাই বিএনপি জোট ছাড়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।