বিশ্বের ১৮০টি দেশের তথ্য নিয়ে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)-২০২১’ অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। এবার ১৩তম হয়েছে। তবে করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) বা দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের তিন বছরের মতো বাংলাদেশের স্কোর ২৬। এর আগে ২০২০, ২০১৯ ও ২০১৮ সালেও একই স্কোর ছিল।
এই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা আছে। দেশের অর্থনীতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দুর্নীতির পেছনে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মত প্রকাশ ও জবাবদিহির অভাবকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
গত বুধবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ-২০২১ : উদ্যোক্তা জরিপের যে ফল প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন দুর্নীতি ব্যবসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। দুর্নীতির পাশাপাশি অদক্ষ আমলাতন্ত্রও একটি সীমাবদ্ধতা বলে মনে করে সিপিডি।
প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতি দূর করা যাচ্ছে না কেন?
১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণটি সম্প্রতি নজরে এলো। নির্দেশনামূলক অনেক কথাই উঠে এসেছিল তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায়। বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবেই জানতেন বাংলার সাধারণ মানুষের মনের কথা, সরকারি অফিস-আদালতে গিয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথা, তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুবিধা-অসুবিধার কথা। আর সে কারণেই তিনি ওসব বিষয়কে প্রাধান্য দিতে ভুল করেননি।
সেটি ছিল দেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণ অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার পথপরিক্রমায় গৃহীত প্রাথমিক পদক্ষেপ। জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আলোকে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই সেদিন বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে ওভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি শোষণের জাঁতাকল থেকে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করার জন্য ওই চিন্তা করেছিলেন।
দেশের রাজনৈতিক আর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট যে ধারায়ই প্রবাহিত হোক না কেন, বিদ্যমান দুর্নীতি বাস্তব অর্থে যেকোনো পদ্ধতির প্রশাসনের জন্যই যে এক বড় অন্তরায়, তা কোনো রাখঢাক ছাড়াই বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। দুর্নীতি প্রসঙ্গে কথা বলার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বড় জিনিস হলো, একটা লাস্ট কথা, যেটা আমি বারবার বলি, করাপশন। আমি আমার সহকর্মীদের ভেতর থেকে যাদের দিচ্ছি এবং এ পর্যন্ত যাদের আমি গভর্নর করেছি, তাদের প্রতি সরকারি কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে সবার প্রতি আমার আস্থা আছে। আমি বিশ্বাস করি, তারা করাপশনের ঊর্ধ্বে থাকবে। কিন্তু শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়াই করাপশন নয়। এ সম্পর্কে আমার কথা হলো করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজমও কিন্তু এ টাইপ অব করাপশন। স্বজনপ্রীতিও করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করুন। কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। কারো ভয় নেই। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেন না। আমিও আপনাদের সঙ্গে আছি। ’
এ কথা সত্য, প্রশাসনিক ওই কাঠামোতে বাংলাদেশ আর হাঁটতে পারেনি। ফলে দুর্নীতির সেই যে মহামুক্তি ঘটল, বোধ হয় সেই গতি আর থামানো যায়নি। নির্মূল হওয়া তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র কমেনি, আরো বেগবান হয়ে পাকাপোক্ত হয়ে গেড়ে বসে। অনুকূল পরিবেশ আর আন্তরিক পরিচর্যায় বরং বিস্তারিত নতুন নতুন ডালাপালা আর ফুলে-ফলে ভরে দুর্নীতি নামের বৃক্ষটি আজ এক বিস্ময়কর মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তার সেই ছায়া-সুনিবিড় ছত্রচ্ছায়ায় মহাধুমধামে চলছে হাজার মানুষের আরাম-আয়েশের মহাকীর্তন। অন্যদিকে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন মরীচিকার মতো দূর থেকে দূরে, দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে আমরা দুর্নীতির যে প্রকারগুলোর উল্লেখ পাই তা হলো, সরাসরি ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে দুর্নীতিতে সাহায্য করা এবং স্বজনপ্রীতি। স্বজনপ্রীতি আর ঘুষখোরদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আর আজ আমার কাছে আপনারা তওবা করে যান যে স্বজনপ্রীতি করবেন না। ঘুষখোরদের সাহায্য করবেন না। মাত্র কয়েকটি লোকের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দূর করা যায় না—আমি এর প্রতিকার দেখতে চাই। ’
১৯৭৫ থেকে ২০২২। সময়ের এ ব্যাপ্তিতে দুর্নীতির প্রকারভেদে কোনো হেরফের ঘটেছে বলে মনে হয় না। সেই সময় হয়তো গুটিকয়েক লোকের সরাসরি ঘুষ খাওয়ার বা দুর্নীতির সঙ্গে ওঠাবসার অভ্যাস ছিল। তখন তার প্রতিকার করা যায়নি বলেই আজকে আমাদের প্রতিটি পদে খেসারত দিতে হচ্ছে। দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপ্তি যে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। দুর্নীতির বীজ যখন রয়ে গেছে এবং দেশের অর্থনীতির আকার যখন অনেকটাই বেড়ে গেছে, তখন দুর্নীতির বীজের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে চারদিকে তো ছড়াবেই। কারণ ক্ষেতে নিড়ানি না পড়লে ঘাসেই একদিন ফসল খেয়ে ফেলে—এটাই বাংলার কৃষক এত দিন দেখে আসছেন। আমরাও যে দেখি না তা কিন্তু নয়, তবে কিছু বলি না বা কিছু করার ক্ষমতাই আমাদের নেই।
স্বজনপ্রীতি দুর্নীতিরই আরেকটি রূপ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বজনকে সুবিধা প্রদান বা নিজস্ব দুর্নীতিকে ঢেকে রাখার জন্য স্বজনকে ব্যবহার করা—সব দুর্নীতিরই নামান্তর। স্বজনপ্রীতি শুধু অন্যায়ই নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বজনপ্রীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে দুর্বল করে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মেরুদণ্ডে আঘাত হানে। আর সেই দুর্বল মেরুদণ্ডের ওপর রাষ্ট্র কখনো ভর করে দাঁড়াতে পারে না। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নেরই ব্যাঘাত ঘটে না, অস্তিত্বের হুমকিতে উপনীত হয়। স্বজনপ্রীতি রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে একদিন বিকল করে দেয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বজনপ্রীতিকে উৎসাহিত করার অর্থ দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া, সমাজে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা।
দুর্নীতির হাতে বন্দি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না বলেই তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে আমার অসহ্য লাগে, যখন ভাবি, কেন এই করাপশন সমাজের মধ্যে ঢুকেছে?’ দুর্নীতির থাবা থেকে তাঁর প্রিয় দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য তিনি দুর্নীতি বন্ধ করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি আশা করে বলেছেন, ‘অন্য কাজ করুন বা না করুন, এটা করবেন। দুর্নীতি যেন আর না থাকে। ’
দুর্নীতি একটি সমাজ বা দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ তা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন ছিল না। কারণ তিনি যে এই মানুষের মধ্যে, বাংলার এই আলো-বাতাস-মাটি-জলেই বড় হয়েছেন। তাইতো বঙ্গবন্ধু সব কিছুর ঊর্ধ্বে দুর্নীতি বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সমাজ থেকে দুর্নীতি তাড়াতে না পারলে যে দেশ থেকে দুর্নীতি তাড়ানো যাবে না। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমাজের প্রত্যেক মানুষই জানে ও চেনে। যখন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনে সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাস চলে, তখন সেই সমাজব্যবস্থায় ন্যায়, সততা ও আইনের শাসনের মৃত্যু ঘটে। একদিন সেই সমাজ তথা দেশ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। সমাজ থেকে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, মনুষ্যত্ব ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিলুপ্তি ঘটে। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের দাপটে সৎ মানুষগুলো বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগও খুঁজে পায় না।
সরকারি অফিস-আদালতে কোনো সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়, না হলে কোনো সেবাই পাওয়া যায় না। এই ঘুষের জন্য তাদের যেভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয় তা বঙ্গবন্ধু জানতেন। কারণ তিনি ছিলেন এ দেশের মাটি ও মানুষের অতি কাছের জন, আপন মানুষ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ওই অবহেলিত মানুষেরই নেতা। তিনি বলতে ভুলে যাননি, ‘আর একটি কথা আমি আজ আপনাদের বলে দিতে চাই। থানায় এসে যেন মানুষ বসতে পারে, তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সাবরেজিস্ট্রার অফিসে এসে তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সিও অফিসে যেন পয়সা দিতে না হয়। কোর্টে এসে যেন পয়সা না দিতে হয় এবং তাদের যেন হয়রানি করা না হয়। ’
তখন হয়তো কিছু অফিসে ঘুষের ব্যবসা চলত। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতির শিকড় এতটাই গভীরে প্র্রথিত হয়েছে যে মূলোৎপাটন করা বড়ই কঠিন। সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেনি। মানুষ গড়ার বা মানুষের জীবন রক্ষা করার কাজে যাঁরা নিয়োজিত সেই শিক্ষক ও ডাক্তার, অর্থাৎ শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রও আজ দুর্নীতির ছোবলে কুপোকাত। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, উভয়েই সমান অপরাধী’—নীতিবাক্যটি এখন বড়ই পুরনো। বর্তমানে ‘ঘুষ যে খায় আর যে দেয়, উভয়েই সমান উপকৃত হয়’ ধারায়ই যেন দেশ চলছে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো খুব কম দেশেই দুর্নীতিবাজদের এমন বেপরোয়া ও নির্লজ্জ হতে দেখা যায়। অথচ লাখো শহীদের রক্তে এ দেশের জন্ম। কোথায় আমাদের সেই অঙ্গীকার আর দেশপ্রেম? আমরা কি বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশে পরিণত করতে পারি না? দুর্নীতিকে এ দেশের মাটি থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করার আরেকটি মুক্তিসংগ্রামে আমরা কি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না? আমরা আর কতকাল সেই নেতৃত্বের অপেক্ষায় থাকব, যিনি আমাদের এমন সংগ্রামের জন্য ডাক দেবেন? আমি বিশ্বাস করি, দেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ সেই নেতৃত্বের পাশে দাঁড়াতে সামান্যতম বিলম্ব করবে না। শুধু একটি বজ্রকণ্ঠের অপেক্ষায় সব দেশবাসী।
বঙ্গবন্ধুর কথাগুলোর প্রতিধ্বনি করেই লেখাটি শেষ করতে চাই—অন্য কাজ করুন বা না করুন, দুর্নীতি বন্ধ করুন। তবেই দেখবেন সমাজের সব কলুষতা কেটে গিয়ে দেশে ন্যায়বিচার, সততা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। মানুষের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন গতিধারাকে নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ যে আমাদের সামনে খোলা নেই। এ কথা সত্য যে এ কাজটি খুবই কঠিন ও জটিল, তবে সাধ্যাতীত নয়। দেশপ্রেম, শক্তিশালী মনোবল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশে অবশ্যই দুর্নীতির গতিকে অনেকটাই নামিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সেদিনের আহ্বানের ইতিবাচক সমাপ্তি সম্ভব হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব