বাংলাকে হতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ভাষা

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলা ভাষা
প্রতীকী ছবি

আমার প্রয়াত বন্ধু সৈয়দ শামসুল হক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভাষাকন্যা উপাধি দিয়েছিলেন। এর একটি কারণও ছিল। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের ব্যাপারে তাঁর একটা বিরাট ভূমিকা আছে। ইউনেসকোর প্যারিস সম্মেলনে তাঁর উদ্যোগেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃৃভাষা দিবস করা হয়।

এই সুবাদে আমার লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গান হয়। এখন তা ১১টি কি ১২টি দেশে তাদের ভাষায় গীত হয়। বাংলাদেশের এত বড় সম্মান শেখ হাসিনার উদ্যোগেই অর্জিত হয়। আজ সেই ভাষার মাসের প্রথম দিবস।

এই দিবসে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন—সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে বাংলাভাষীদের মধ্যে আজ থেকে শুরু হবে ভাষার মাসের অনুষ্ঠান। আগে এই অনুষ্ঠান ছিল একটা আন্দোলন। ভাষার জন্য লড়াকু মানুষের আন্দোলন। এই আন্দোলন সাফল্য লাভ করার পর অর্থাৎ বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে। এখন এটা অনুষ্ঠানমাত্র। সারা বিশ্বে এই অনুষ্ঠান হয়।

কিন্তু অনুষ্ঠান দিয়ে ভাষার অগ্রগতি হয় না। ভাষার অগ্রগতির জন্যও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়। কবি জিওফ্রে চসারের আগে ইংল্যান্ডের রাজকীয় ভাষা অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা ছিল ফরাসি। ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি ফরাসি ভাষায় কথাবার্তা বলে আভিজাত্যের গৌরব অনুভব করত। কবি চসার প্রথম ফরাসি ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংরেজ কবিরা ফরাসি ছেড়ে স্বদেশি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। এর পরও ইংরেজি ভাষা সংস্কারের আন্দোলন চলে। বার্নার্ড শ আধুনিক ইংরেজি ভাষারও সংস্কার ও সম্প্রসারণ দাবি করেছিলেন। সেই থেকে ইংরেজি ভাষায় নিত্যনিয়ত শব্দচয়ন ও সংগ্রহ চলছে। বাংলা ভাষা থেকেও পণ্ডিত, ধর্মঘট, বাংলো ইত্যাদি শব্দ তারা আহরণ করেছে।

বাংলা ভাষা এদিক থেকে দরিদ্র। বাংলাদেশের কবিরা বাংলা ভাষায় জনগণের মনের কথা এখনো লিখতে পারছেন কি না সন্দেহ। এদিক থেকে কবি শামসুর রাহমান ইংরেজ কবি চসারের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বলা চলে। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষায় এন্তার উর্দু-ফারসি শব্দ ঢোকানো শুরু হয়। তিনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এ জন্য তাঁর কবিতা সরকারি পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো না। তাঁর ‘রূপালি স্নান’ নামে একটা কবিতা আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হওয়ার পর অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর দেশের সরকারও তাঁকে সম্মানিত করে। শামসুর রাহমান দেশের প্রধান কবি। তিনি আজ নেই। কিন্তু তাঁর প্রতিভার সার রয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি কবিদের কবিতায়।

বাংলা গদ্যেও প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। আমরা ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছি। বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে এবং গবেষকরা বাংলা ভাষাকে নানা গবেষণা দ্বারা সমৃদ্ধ করছেন। এতদসত্ত্বেও বাংলা ভাষার জন্য একটি নতুন আন্দোলন প্রয়োজন।

বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কোথাও তার ব্যবহার নেই। বাংলাকে ব্যাবহারিক ভাষা করে তুলতে না পারলে এই ভাষা শুধু সাহিত্যের ভাষা হয়ে থাকবে। সাধারণ মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের ভাষা হয়ে উঠতে পারবে না। বাঙালি ডাক্তার বাংলায় ওষুধের প্রেসক্রিপশন এখনো লিখতে পারেন না। বাংলায় কোনো বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক চিঠি লেখা যায় না।

বাংলা ভাষা যখন একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা, তখন তাকে ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষার মতো বিজ্ঞানের ও কারিগরি শিক্ষাচর্চার ভাষা করে তুলতে হবে। বাংলায় যাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষাদান করা যায় সে জন্য শুধু গবেষণা নয়, আন্দোলনও দরকার। পণ্ডিতরা অনেক সময় তাঁদের রক্ষণশীলতার জন্য ভাষা সংস্কার করতে পারেন না; যেমন পণ্ডিতরা টেলিফোনের বাংলা করেছিলেন ‘দূরালাপনী’ এবং চিফ সেক্রেটারিকে করেছিলেন ‘মহাকারণিক’। ভ্যানিটি ব্যাগের হিন্দি করা হয়েছিল ‘ফুটানিকা ডিব্বা’! এর একটিও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। তারা টেলিফোন, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি শব্দকে নিজেদের ভাষা করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ পর্যন্ত এখন জানে ‘হাইজ্যাক’ শব্দের অর্থ কী। সবাই এর অর্থ জানে এবং ব্যবহার করে।

বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য শুধু বাংলা ভাষায় বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ নয়। তাকে বিদেশি ভাষা থেকে বিজ্ঞান ও কারিগরি চর্চার নতুন নতুন শব্দ আহরণ করতে হবে। বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ রচনার উপযোগী করে তুলতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশে জিম্বাবুয়ের মতো গণ-আন্দোলন দরকার। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের শাসনামলে ইংরেজি ভাষাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সরকারি কাজের সব স্তরে জিম্বাবুইয়ান ভাষা ব্যবহারে জনগণকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু মুগাবে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাদানের শব্দ ইংরেজি ভাষা থেকে তাঁর ভাষায় গ্রহণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন তাদের কোনো কোনো স্বদেশি ভাষায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হয়। কোনো কোনো আফ্রিকান দেশে যা সম্ভব হয়েছে, বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি। তার কারণ আমাদের রক্ষণশীল আমলাতন্ত্রের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রতি অতিরিক্ত প্রভুভক্তি।

বাংলা ভাষার জন্য শহীদ সালাম, বরকত, রফিক আত্মদান করেছেন। এখন তাঁদের সেই আত্মত্যাগকে শুধু স্মরণ করা হয়। কিন্তু তাঁরা যে উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য পূরণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে নিজের ভাষাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা করেছেন। এখন সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। এরই সঙ্গে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান উচ্চস্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা উচিত। বাংলা ভাষার সংস্কার ও উন্নতির জন্য আরো দরকার পণ্ডিতদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদেরও সংযোগ স্থাপন করা। প্রতি জেলায় ও উপজেলায় জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন করে তার সঙ্গে জাতীয় গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা এবং তা হবে বাংলা ভাষায়।

এই উন্নত বাংলাকে তৈরি করার জন্য আন্দোলন দরকার। একুশের আবেগ ও ত্যাগকে শুধু গান-বাজনা দ্বারা পালন না করে তাকে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার দিবস হিসেবেও গ্রহণ করা উচিত। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা এবং রুশ ভাষাও আজ বিশ্বে সর্বাধিক উন্নত সাহিত্যের ভাষা। রবীন্দ্রনাথ তাদের ভাষার কাছাকাছি বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে তুলে এনেছেন। কিন্তু দেশে এখন নতুন জগদীশচন্দ্র ও কুদরাত-এ-খুদার প্রয়োজন, যাঁরা বাংলা ভাষাকে বিজ্ঞানের ভাষা করে তুলবেন।

এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকেও আধুনিক প্রযুক্তির ভাষা হতে হবে। নইলে বাংলাদেশ বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির যুগে পিছিয়ে যাবে। ভারত এদিক থেকে এগিয়ে গেছে। বাংলা ভাষাকেও এগোতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিই পারে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে যাওয়ার সেই উদ্দীপনা দিতে। ২০২২ সালের ভাষার মাসে তাই প্রার্থনা করি একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি ভাষা আন্দোলনের জন্ম দিক।

লন্ডন, সোমবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২২

শেয়ার করুন