বিএনপির কাছে ‘ভোট চুরির প্রকল্প’, আওয়ামী লীগের অভিনন্দন, জাপার ‘পর্যবেক্ষণে’

হাসান শান্তনু

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে ‘অনুসন্ধান কমিটি’ (সার্চ কমিটি) গঠিত হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও প্রতিক্রিয়ায় কমিটির সামনের কার্যক্রমের দিকে গভীর মনোযোগ রাখার কথা ব্যক্ত করছেন। কমিটি নতুন ইসি গঠনে কী ভূমিকা রাখতে পারে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, সেসবেরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন তাঁরা। একইসঙ্গে বিশিষ্ট নাগরিকরা সার্চ কমিটিকে ঘিরে জনপ্রত্যাশার কথাও বলছেন সংবাদমাধ্যমের কাছে।

রাষ্ট্রপতির ঘোষিত সার্চ কমিটি’ নিয়ে ‘আগ্রহ’ নেই বিএনপির। রাজনীতির মাঠে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলটি ওই কমিটিকে ‘আওয়ামী লীগ সরকারের ভোট চুরির প্রকল্প (প্রজেক্ট)’ বলে অভিহিত করছে। গঠিত ‘কমিটি অর্থহীন’ মন্তব্য করে দলটি বলছে ‘এর কোনো মূল্যই নেই।’ যে আইনের অধীনে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে, সেই আইনে ‘জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি’ বলে অভিযোগ সংসদে প্রধান বিরোধিদল জাতীয় পার্টির (জাপা)। অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে কাদের নাম প্রস্তাব করে, তা গভীরভাবে ‘পর্যবেক্ষণ’ করছে দলটি। জাপার মতে, অনুসন্ধান কমিটির সবাই ‘ভালো লোক’।

দেশের প্রাচীন দল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সার্চ কমিটিকে অভিনন্দন, স্বাগত জানিয়েছে। দলটির ভাষ্য, কমিটি নিরপেক্ষ ইসি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শক্তিশালী, বিতর্কমুক্ত ইসি গঠনে সার্চ কমিটিকে যথেষ্ট স্বাধীনতা ও সুযোগ সদ্য প্রণীত আইনে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছরের মধ্য এবারই প্রথমবারের মতো আইনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ইসি গঠনে আইন প্রণয়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। সরকারি দলের পক্ষে সার্চ কমিটির বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

বিশিষ্ট নাগরিক ও সুশীল সংগঠনগুলোর ভাষ্য, সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ইসি গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বাছাই করা হবে অনুসন্ধান কমিটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইসি গঠনে গঠিত কমিটি চাইলেই এমন একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে, যা মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে। অনুসন্ধান কমিটিকে স্বচ্ছ অনুসন্ধানের আহ্বান জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সার্চ কমিটির পক্ষে প্রস্তাবিত নামগুলোর তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)।

‘নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ইসি’ গঠনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রস্তাবে আইন ও সংবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালন করার প্রত্যয় জানিয়েছেন বিচারপতি ও সার্চ কমিটির সভাপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের এ বিচারপতিকে প্রধান করে ইসি গঠনে নাম প্রস্তাবে অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অনুমোদনের পর শনিবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

ইসি গঠন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘খেলতে না নেমে রেফারি ভালো নয়, এমন অপপ্রচার চালানো ঠিক নয়। আসুন, ভয় না করে মাঠে খেলতে নামুন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।’ যোগাযোগ করলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মত ও পথকে বলেন, ‘কমিটির বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা মনে করি, অনুসন্ধান কমিটি, নির্বাচন কমিশন—সবই সরকারের অধীন। এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।’

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মত ও পথকে জানান, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি আওয়ামী লীগ সরকারের ভোট চুরির প্রজেক্ট (প্রকল্প)। এ কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা নেই। জণগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে আসবে না কমিটি।’ জাপার চেয়ারম্যান, সংসদের বিরোধিদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেন, ‘আমরা চাই, গঠিত সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করবেন, যারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারবেন। কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করবে, তা দেখার অপেক্ষায় আছি।’

ইসি গঠনের গুরুদায়িত্ব পালনে অনুসন্ধান কমিটিকে আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছে টিআইবি। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ ইসি গঠনের পেছনে যে সাংবিধানিক চেতনা অন্তর্নিহিত এবং একে নিয়ে জনগণের যে প্রত্যাশা, তা পূরণে কোনো রকম ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। কমিটির স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন যেন নিশ্চিত করা হয়।’

অনুসন্ধান কমিটির অনুসন্ধান যেন স্বচ্ছ হয়, এ আহ্বান জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মত ও পথকে শনিবার রাতে মুঠোফোনে বলেন, ‘একটি অনুগত ইসি জাতি হিসেবে আমাদের চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে। বৃহত্তর স্বার্থে নবগঠিত অনুসন্ধান কমিটিকে সঠিক ব্যক্তিদের ইসিতে নিয়োগের জন্য বাছাই করতে হবে। আইনের ৪ (১) ধারায় উল্লেখিত স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে অনুসন্ধান করলেই তা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

শেয়ার করুন