‘৭১’ পরবর্তী বাংলাদেশের ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ ছিলেন যারা

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন ১২ জন। সাবেক সিইসিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি এ.কে.এম. নুরুল ইসলাম। তিনি সর্বোচ্চ প্রায় ৮ বছর এ পদে ছিলেন। সর্বনিম্ন ১০ মাস সিইসি ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান।

নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগে এগিয়ে আছেন দেশের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা। সাবেক ১২ সিইসির মধ্যে সাতজনই ছিলেন বিচারপতি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিইসি ছিলেন একজন বিচারপতি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ পদে বিভিন্ন মেয়াদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরাই দায়িত্ব পালন করেছেন। তুমুল বিতর্কের মুখে ২০০৭ সালের শুরুতে যিনি সিইসি পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন তিনিও একজন বিচারপতি।

এর মাঝে এই পদে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েকজন সাবেক আমলা। যাদের কেউ কেউ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) কর্মকর্তা ছিলেন। স্বাধীনতার পর যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের(বিসিএস) কর্মকর্তা হিসেবে।

এক নজরে ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন

ইদ্রিস কমিশন :বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ তাঁর কমিশনের মেয়াদ ছিল ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই৷ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এই কমিশন৷

নুরুল ইসলাম কমিশন :বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার৷ তিনি ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই দায়িত্ব নেন৷ অব্যাহতি নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি৷ টানা আট বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি৷

মাসুদ কমিশন : বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী এ.টি.এম. মাসুদ। ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী পাঁচবছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিদায় নেন ১৯৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এই কমিশনের অধীনে৷

সুলতান কমিশন : বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ছিলেন দেশের চতুর্থ সিইসি। তিনি ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ তবে মাত্র দশ মাস দায়িত্ব পালন করেন৷ ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷

রউফ কমিশন : বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের পর বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ সিইসি হিসেবে নিযু্ক্ত হন৷ গণতন্ত্র পুণরুদ্ধারের ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে তাঁর কমিশন৷ তিনি ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন৷

সাদেক কমিশন : বিচারপতি একেএম সাদেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিযুক্ত হন ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল৷ তাঁর কমিশনের অধীনেই হয় ১৯৯৬ সালের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন৷ তাঁর মেয়াদ ছিল ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত৷

হেনা কমিশন : টানা ছয়জন সাবেক বিচারপতি সিইসি পদে দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতা ভাঙেন সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনা। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ তাঁর অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ ২০০০ সালের ৮ মে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন আবু হেনা। তিনি চার বছর সিইসি পদে ছিলেন।

সাইদ কমিশন :২০০০ সালের ২৩ মে সিইসি পদে নিয়োগ পান আরেক সাবেক সচিব এম এ সাইদ। তিনি পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে ২০০৫ সালের ২২ মে বিদায় নেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তাঁর কমিশনের অধীনে৷

আজিজ কমিশন :বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত কমিশন আজিজ কমিশন৷ বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২২ মে সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ ব্যাপক রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন৷ পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ তফসিল বাতিল করেন৷ ২১ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন এম এ আজিজ৷

শামসুল হুদা কমিশন:সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এমএ আজিজের উত্তরসূরী হন এটিএম শামসুল হুদা৷ তাঁর কমিশন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে৷ তাঁর মেয়াদ ছিল ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত৷

রকিবউদ্দীন কমিশন :২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় রকিবউদ্দিন কমিশন৷ সাবেক এই সচিবকে নিয়োগ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান৷ আওয়ামী লীগ সরকারের এই মেয়াদেই সংসদে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই এই কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরিচালনা করে, যেখানে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷ পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবার পর ২০১৭ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান রকিবউদ্দিন৷

নুরুল হুদা কমিশন :রকিবউদ্দিনের পরই সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে শপথ নিয়েছিলেন কে এম নূরুল হুদা। তিনি ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷

শেয়ার করুন