নগরসভ্যতার ক্রমবিকাশে নাগরিকদের জীবনে এসেছে নানামুখী আধুনিকতার ছাপ। গ্রামের মানুষ অনেকে হয়েছেন শহরবাসী। এভাবে নিত্যদিন বেড়েই চলেছে নগরবাসীর সংখ্যা। এই আধুনিক জীবনের পদার্পণে দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে নগরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণের মাত্রা।
মূলত ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এসব দূষণ কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। নানামুখী দূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চরক্তচাপ (ব্লাড প্রেসার), হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জি সমস্যা বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকিও। ফলে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং দ্রুত হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় দূষণ বাড়ার উপযোগী উপাদান দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া দূষণের জন্য দায়ী।
আন্তর্জাতিক জার্নাল কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, বায়ু দূষণকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বায়ু দূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমেছে। অকালে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী কণার প্রভাব মানুষের ফুসফুসে প্রায় এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ু দূষণের প্রভাব ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব।
দূষণের অন্যতম বড় উৎস হচ্ছে বর্জ্য। রাজধানীতে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলায় এটি মারাত্মক সমস্যারূপে চিহ্নিত হয়েছে। রান্নাঘরের বর্জ্য থেকে শুরু করে পরিধেয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, কাগজ, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর বর্জ্যও উৎপন্ন হচ্ছে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিনগুলো ময়লা আবর্জনায় উপচানো থাকে। সেখান থেকে জীবাণু ও দুর্গন্ধ ছড়ায়। শহরের কল-কারখানাগুলো থেকে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়বহুল বলে অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো মুক্তভাবে শহরের খাল-বিল নদী-নালায় ফেলছে। এগুলোর মধ্যে কাপড়ের রং, চামড়াশিল্পে উত্পন্নবর্জ্য, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কলকব্জা এসব উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সময়ে ঢাকায় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ অধিকহারে চলছে।
দেখা যায়, কাজ শেষে ময়লার ভাগাড়ে ইট, বালু, নুড়ির স্তূপ পড়ে থাকে। এগুলো শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নষ্ট করছে। ফলে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। শহরবাসী সম্মুখীন হচ্ছে কৃত্রিম বন্যার। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতেও কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। ব্যবহৃত ওষুধের প্যাকেট, সুচ, সিরিঞ্জ, ছুরি-কাঁচি ইত্যাদি বর্জ্য বিপজ্জনক এবং কিছু ক্ষেত্রে সংক্রামক রোগের বাহকও বটে। তাই এসব বর্জ্য ঢাকনাসহ বাক্সে রেখে আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনা করা উচিত।
রাজধানীতে প্রতিদিনই বাড়ছে শব্দদূষণের মাত্রা। যেসব সড়কে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা মানছে না কেউই। অতিমাত্রায় শব্দদূষণের কারণে বধিরতার পাশাপাশি বাড়ছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা। হাসপাতাল, স্কুল এবং আবাসিক, বাণিজ্যিক, মিশ্র ও শিল্প এলাকা- চিহ্নিত করে যে শব্দসীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার, তা মানছে না কেউ। গাড়ির হর্ন, নির্মাণ কাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানার শব্দ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ৬০ ডেসিবেল শব্দ মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট করতে পারে। আর ১০০ ডেসিবেল শব্দ চিরতরে শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে। এই হিসাবে রাজধানীতে শব্দদূষণ মানুষকে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছে। শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছেন সব বয়সি মানুষ। বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। চিকিত্সকরা বলছেন, শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণশক্তি কমা ছাড়াও মানুষের উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ঢাকায় সাধারণভাবে যানবাহন ও হর্নের শব্দই শব্দদূষণের মূল কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এর বাইরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার আরেকটি বড় কারণ। আর রাস্তা ছাড়া বাড়ি বা আবাসিক এলকায় বিয়েসহ নানা সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চমাত্রার শব্দযন্ত্র ব্যবহার এবং গানবাজনা অন্যতম কারণ।
রাজধানী ঢাকাকে দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব কেবল সরকার কিংবা কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি বিশেষের নয়, এ দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে যারা অজ্ঞতাবশত রাজধানীর পরিবেশ দূষণে যুক্ত হচ্ছেন তাদের যেমন সচেতন করা প্রয়োজন, তেমনি যারা অতি মুনাফার লোভে জেনেশুনেও রাজধানীর পরিবেশের তোয়াক্কা করছেন না, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্হা করতে হবে। রাজধানী ঢাকার পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে শুধু পরিবেশ আইন প্রণয়ন না করে বরং সেই আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। দূষণের ভয়াল থাবা থেকে রাজধানীকে রক্ষার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা