প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘চমক’ নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীর প্রস্তাবিত নাম থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে কমিশনের অধীনে আয়োজন হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের। সিইসিসহ নতুন চার নির্বাচন কমিশনারের আগের পেশাগত জীবনের কর্মদক্ষতা, সততা, কোনো বিতর্কে জড়িয়েছেন কী না, ইত্যাদি আলোচনায় আসছে। অনুসন্ধান কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা যেসব সুপারিশ করেন, ইসিতে—এর প্রতিফলন নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে।
সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল নতুন সিইসি। অনুসন্ধান কমিটির কাছে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি, বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন চার নির্বাচন কমিশনার হলেন সাবেক জেলা-দায়রা জজ রাশিদা সুলতানা, ব্রি. জে. (অব.) আহসান হাবীব খান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান।
রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে অনুসন্ধান কমিটির কাছে তিন শতাধিক নামের প্রস্তাব আসে। বিতর্কিত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজনের নাম ঢুকে যায় তালিকায়। আলাপ-আলোচনা, খোঁজ নেওয়াসহ নানা যাচাই-বাছাইয়ে তাদের নাম বাদ পড়ে। ইসি গঠনের দুই সপ্তাহ আগে চাকরি থেকে ‘ইস্তফা’ দিয়ে আলোচিত সাবেক যুগ্মসচিব আবুল কাসেমের নাম প্রস্তাবিত তালিকায় থাকলেও নতুন ইসিতে ঠাঁই হয়নি তাঁর।
সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল সর্বশেষ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। এর আগে তিনি আইন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত জীবনে তাঁর সততা নিয়ে আলোচনা আছে। ২০০৯ সালে আইন সচিব থাকাকালীন এক বিচারক তাঁকে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ করে বক্তব্য দিলে তিনিও এর জবাব দেন। আইন সচিব হিসেবে তাঁর নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে রায় দেন আদালত। আইন সচিব থাকা অবস্থায় দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়ে তিনি আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন।
সংসদীয় কমিটি এ জন্য তাঁকে তলব করলে তিনি ওই ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমাও চান। এ ছাড়া সাবেক দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে নিয়ে বড় কোনো বিতর্ক নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের পক্ষে অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন ও দলনিরপেক্ষ বক্তব্য দিয়ে তিনি সাহসী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
যোগাযোগ করলে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল শনিবার রাতে মুঠোফোনে মত ও পথকে বলেন, ‘সিইসি হিসেবে দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করব। সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। কমিশনের অন্য সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁদেরকে নিয়ে বসে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করব।’
তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ইসি প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মত ও পথকে বলেন, ‘হাবিবুল আউয়াল সচিব থাকাকালে তদ্বির করেননি। তদবির করে এক্সটেনশন নেননি। তিনি প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালে সেনাবাহিনীর বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কাজ করেছিলেন। অন্যান্যা বাহিনী, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিল দেয় বর্তমান মূল্যে আর সেনাবাহিনী বিদ্যুৎ বিল দেয় ১৯৭২ সালের রেটে। তখন তিনি (কাজী হাবীবুল আউয়াল) বললেন- এটা হবে না।’
তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীকেও অন্যদের মতো বর্তমান মূল্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন অনেকেই তাঁর (কাজী হাবীবুল আউয়াল) ওপর ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরেননি। আমি মনে করি, তাঁর সততার জোর আছে। তিনি পারবেন আমাদের প্রত্যাশিত ইসির নেতৃত্ব দিতে।’
সচিবালয়ে নির্যাতনের পর প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করার পর সাবেক সচিব কাজী হাবীবুল আউয়াল—এর সমালোচনা করেন। বলেন, ‘সরকার গুপ্তচরবৃত্তি ও সরকারি গোপনীয়তাকে গুলিয়ে ফেলেছে।’ লেখালেখিও করেন সিইসি। ‘জীবন পাতার জলছাপ’ ও ‘ট্রাজেকটরি অব এ জুডিশিয়াল অফিসার’ তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বই। অবসরের পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কলাম লেখেন।
তাঁর বাবা কাজী আবদুল আউয়াল কারা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার সময় তিনি কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) ছিলেন। পরে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বাদী হয়ে মামলা করেন কাজী আবদুল আউয়াল।
ধর্মীয় ও জাতিগত ‘সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর’ পক্ষ থেকে অন্ততপক্ষে একজনকে ইসিতে অন্তর্ভুক্ত করতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক দাবি জানায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিশিষ্টজনদের বৈঠকে ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি থেকে কাউকে ইসিতে রাখতে নাম প্রস্তাবের সুপারিশ করেন। তবে ইসিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি নেই।