‘সাংবাদিকতার’ নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। এ পেশার নামে অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা দেশজুড়ে। এতে মূলধারার সাংবাদিকদের সম্পর্কে সাধারণ, অসচেতন মানুষের ‘নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’ তৈরি হচ্ছে। প্রায় সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন প্রকৃত, পেশাদার সাংবাদিকরা। বিষয়টি তাদেরকে উদ্বিগ্ন করছে।
দৈনিক সংবাদ সারাবেলার উপসম্পাদক আমিনুর রহমান তাজ এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘সাংবাদিকতা একমাত্র পেশা, যেখানে নিয়মনীতির তেমন তোয়াক্কা নেই। এতে নাম লেখাতে শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার পড়ে না। প্রচারমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে বাছবিচার না থাকায় অপেশাদারের হাতে মালিকানা যাচ্ছে। এতে অপেশাদারদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। সাংবাদিক পরিচয়পত্র কেনা-বেচা করে স্বল্পশিক্ষিত তরুণ, যুবককে মাঠে নামিয়ে চাঁদাবাজি করানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নজরদারি না থাকায় অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন, অসাধু ও মামলায় দণ্ডিতরা যেন কোনোভাবে মালিকানা না পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে।’
যোগাযোগ করলে দৈনিক মানবকণ্ঠের প্রধান প্রতিবেদক বাছির জামাল বলেন, ‘সাংবাদিকতা পেশায় আসার ক্ষেত্রে কোনো গেইট পার হয়ে আসতে হয় না। যা অন্য পেশায় রয়েছে। আইনে ডিগ্রি থাকলেও এডভোকেটশিপ পরীক্ষার সনদপত্র ছাড়া কেউ আইনজীবী হিসেবে কাজ করার অনুমতি পান না। আমাদের পেশায় তেমন কিছু নেই। যে কেউ, যে কোনো সময় সাংবাদিক বলে পরিচয় দিতে পারেন। এ সুযোগই লুফে নিচ্ছেন অপরাধীরা।’
তিনি মনে করেন, ‘এটা পেশার জন্য ক্ষতির কারণ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে পেশায় প্রবেশে সনদপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। সনদ নিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম ডিগ্রি, এর সমমান থাকতে হবে। সনদ দেওয়ার কর্তৃপক্ষ কেমন হবে, তা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে পারেন। একটি আইনি কাঠামো দাঁড় করাতে পারেন। এটা খুবই প্রয়োজন।’
দৈনিক আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক নিয়ন মতিয়ুল বলেন, ‘আমরা যে সাংবাদিকতা করছি, দেশে যে ধরনের সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো গতি-প্রকৃতি নেই। এসবের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ সর্বজনীন সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, সুশাসন, গণতান্ত্রিক ধারায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে সামাজিক জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতার চর্চাই অপরাধীদেরকে অপসারণ করতে পারে। করণীয় এটাই, নতুন ও আগামীর চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানানো। বাধা না দেওয়া।’
দৈনিক ভোরের কাগজের উপপ্রধান প্রতিবেদক ঝর্ণা মনি বলেন, ‘অপরাধীরা সাংবাদিকতাকে পাওয়ার প্র্যাকটিসের জায়গা হিসেবে বেছে নেন। অপরাধ করে কখনো কখনো সাংবাদিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন। সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন। এজন্য দায়ি সাংবাদিকরাই (সবাই নন)। আমরাই আশ্রয় দিচ্ছি তাদেরকে। সাংবাদিকতার নীতিমালা খুব জরুরি। কারা সাংবাদিকতায় আসতে পারবেন, কারা পারবেন না- এটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আইনজীবী হওয়ার জন্য বার কাউন্সিলের সনদপত্রের মতো সাংবাদিক হতে হলে প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রেস কাউন্সিলের সনদের ব্যবস্থা থাকলে পেশার মর্যাদা আরো বাড়তো।’
দৈনিক সারাবাংলা ও সারাবাংলাডটনেটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রতিবেদক আসাদ জামান মত ও পথকে বলেন, ‘মিডিয়া অপকর্মকারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল- এটা পুরনো খবর। মাদক কারবারি, খুনি, ধর্ষক, জঙ্গি, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লে বুঝতে হবে, যারা মূলধারার সাংবাদিকতায় আছি, তারা যথাযথভাবে গেট-কিপিংয়ের কাজটা করছি না। অপরাধীরা তাই আশ্রয় নিচ্ছেন। আরেকটি কারণ হতে পারে- সম্পদ পাহারায় মিডিয়ায় বিনিয়োগ।’
তাঁর মতে, ‘এর রোধ করতে সবার আগে মিডিয়ার নেতৃত্বস্থানে যারা আছেন, তাদেরকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিষ্ঠানে কাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তার ব্যাকগ্রাউন্ড কী, আগে কোথায় কাজ করেছেন- এসব ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ-খবর নিতে হবে। নিয়োগ দেওয়ার পর তার সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর চোখ রাখতে হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রজাবন্ধুর নির্বাহী সম্পাদক এইচ.এম. সিরাজ মত ও পথকে বলেন, ‘সুযোগ পাচ্ছেন, তাই আসছেন অপরাধীরা। এক শ্রেণির প্রতিষ্ঠানপ্রধান অনেকটা কইরা খাও নীতি অবলম্বনে যার-তার হাতে সাংবাদিক পরিচয়পত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন। তারা পেশাকে করছেন কলুষিত। পেশাদার, মেধাবীদের মূল্যায়ন করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।’
দৈনিক সময়ের আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সমীরণ রায় বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম পরিচালনা, সাংবাদিকতার নীতিমালা আছে। তবে কোন কোন যোগ্যতা থাকলে কেউ সাংবাদিক হতে পারবেন, তা নেই। এ কারণে যে কেউ সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন। এটা নিয়ন্ত্রণে সঠিক নির্দেশনা থাকা দরকার। অসাধু সংবাদমাধ্যমের মালিক হলে সেখানে অপসাংবাদিকতা হবে, এটা স্বাভাবিক। সরকার, বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করা দরকার। এটাও ঠিক, সাংবাদিকতা করতে কোনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা গৌণ।’
দৈনিক সময়ের আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক রফিক রাফি বলেন, ‘কেউ কেউ নিজের অপরাধ ঢাকতে সাংবাদিকতায় আশ্রয় নিচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাদের প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসছে। সাংবাদিকতা যেন অপরাধীদের আশ্রয়স্থল না হয়, সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আইনজীবীদের মতো সাংবাদিকদের নিবন্ধন পদ্ধতি শুরু করতে পারলে ভালো হবে।’
নিউজ টাইমসের নিজস্ব প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম আনসারী বলেন, ‘অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত অনেকে এখন গণমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এর দুটি কারণ হতে পারে। এক. গণমাধ্যমের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা। দুই. কিছু ভুঁইফোড় অনলাইন ও ইন্টারনেট টিভি চ্যানেল অপরাধীদের হাতে সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র তুলে দিচ্ছে। এসব বন্ধে গণমাধ্যমের নীতিমালার পাশাপাশি পেশাদার সাংবাদিক সংগঠনগুলোকেও ভূমিকা রাখতে হবে।’