২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যখন ঘোষণা দিলেন, ন্যাটোর সদস্য পদের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছে ইউক্রেন ও জর্জিয়া-তখনই আমি বলেছিলাম, এটি একটি ভয়ংকর আইডিয়া।
ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তি এবং স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার প্রায় দুই দশক পর ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্যপদ প্রদানের আকাঙ্ক্ষা তথা ন্যাটোর সম্প্রসারণ কোনোভাবেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক নয়। আমি অবশ্য কেবল ন্যাটোর প্রভাববলয় সম্প্রসারণের বিরোধী নই; আমি বিশ্বাস করি, একবিংশ শতাব্দীতে কোনো প্রয়োজন নেই ন্যাটোর।
মূলত সেজন্যই ২০০৮ সালে ন্যাটোতে ইউক্রেন ও জর্জিয়ার অন্তর্ভুক্তির অনুমোদনের ভোটে মার্কিন কংগ্রেসকে ‘না’ জানিয়েছিলাম আমি। আমার সেই নেতিবাচক অবস্থানের ব্যাখাও দিয়েছি পরবর্তী সময়ে-যে উদ্দেশ্যে ন্যাটোর প্রতিষ্ঠা, খোদ সেই উদ্দেশ্যেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে।
ফলে এখন ন্যাটো সম্প্রসারণের উদ্যোগ ন্যাটোর স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয় মোটেই, বরং তথাকথিত অরেঞ্জ রেভুলিউশন ও রোজ রেভুলিউশন নামের বিপ্লবের ফলস্বরূপ জর্জিয়া ও ইউক্রেনে নতুন যে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসে, ন্যাটোয় ইউক্রেন ও জর্জিয়ার অন্তর্ভুক্তি প্রকৃতপক্ষে ছিল তাদের জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক পুরস্কার। ইউক্রেন ও জর্জিয়ার সামরিক গ্যারান্টার কেন হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে? তাতে কি মার্কিন সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ কমবে?
সবচেয়ে বড় কথা, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর ছাতার তলায় নিয়ে আসার অর্থ হলো ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে কোনো যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক যুদ্ধ লড়তে হবে, যেখানে তার জাতীয় স্বার্থ অনুপস্থিত।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমার শঙ্কা আজ সত্য প্রমাণিত হলো। রুশ সামরিক কৌশল বিশ্লেষণ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য বোঝার কোনোই দরকার নেই এখন। বুদ্ধিমানরা এমনিতেই অনুধাবন করবেন, ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যপদ নামক যে লাল দাগটি বর্তমানে পুতিন অতিক্রম করে ফেলেছেন, সেটি নিছক খেয়ালবশত নয়। কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটল, তাও কি অপ্রত্যাশিত ছিল? মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কী বলেন?
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দরকার ছিল না ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটানো এবং ইউক্রেন ও জর্জিয়ার মাধ্যমে ন্যাটোর সামরিক শক্তিকে একেবারে মস্কোর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। ওয়াশিংটন কি আরও বেশি নিরাপদ হলো তাতে? বরং আমি বলব, খোদ ন্যাটোর ধারণাটাই একটা ভ্রান্ত আইডিয়া। ১৯৪৯ সালে তাৎক্ষণিকভাবে ন্যাটো গঠনের অনুমতি দেয় মার্কিন সিনেট। ওই সময় ‘মি রিপাবলিক্যান’ খ্যাতি লাভ করেন সিনেটর রবার্ট ট্যাফট। ন্যাটো গঠনের বিপক্ষে ‘না ভোট’ দেন তিনিও এবং সবিস্তারে হাউসে (সংসদ) ব্যাখ্যা করেন কেন ন্যাটো গঠনের বিরোধিতা করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ন্যাটো কার্যত এক বৃহৎ কর্মসূচির অংশ। এর উদ্দেশ্য, সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে সামরিকভাবে প্রস্তুত রাখা।
কিন্তু আমার কথা হলো, যেখানে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর জন্য এরই মধ্যে একটি যৌথ সামরিক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, সেখানে নতুন করে আরেকটি সামরিক সংস্থা কেন? সামরিক ন্যাটোর লক্ষ্য কি তবে আক্রমণাত্মক ও রক্ষণাত্মক উভয়ই? অথচ আমি বিশ্বাস করি, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত শান্তি ও নিরাপত্তা। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ন্যাটোর মতো সামরিক কর্মসূচি বা জোট যতটা না শান্তি উৎপাদন করবে, তার চেয়ে বেশি উসকানি জোগাবে যুদ্ধ বাধাতে।’
টাফট পরবর্তীকালে আরও ব্যাখ্যা করেন, ‘আমরা যেভাবে ন্যাটোকে দেখছি, সেভাবে ন্যাটোকে নাও দেখতে পারে রাশিয়া। আমার কাছে ন্যাটো হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল প্রতিবেশীর সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া (নরওয়ে থেকে ডেনমার্ক, এদিকে তুরস্ক থেকে গ্রিস পর্যন্ত সশস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যুহ)। কিন্তু রাশিয়ার মনে হতে পারে, পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য প্রতিরক্ষার নামে আক্রমণ; নিদেনপক্ষে আক্রমণের হুমকি।
আমি জানি, ন্যাটোকে আক্রমণকারী হিসাবে ভাবার চিন্তাটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন। কিন্তু এ কাজটিই যদি করে বসে রুশরা? উপরন্তু তারা যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমেরিকানরা পশ্চিম ইউরোপকে সশস্ত্র করছে তো যুদ্ধের উদ্দেশ্যেই, তাহলে যুদ্ধটা এখনই করি!’ কতটা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন টাফট!
আমি মনে করি, ন্যাটো তার মূল উদ্দেশ্য থেকে লাইনচ্যুত হয় ২০০৮ সালের আগেই। উত্তর আটলান্টিক চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল কোরীয় যুদ্ধের প্রায় এক বছর পর। ওই সময়কার ন্যাটোর কাজের মূল্যায়ন করতে বললে আমি লিখব সে সময় ন্যাটোর ‘ব্যস্ততা’ ইউরোপের চেয়ে বেশি ছিল এশিয়াকে নিয়ে। অথচ ন্যাটো গঠনের উদ্দেশ্যেই লেখা ছিল, ‘রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় উপায়ে সদস্যদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান’। সামগ্রিক মূল্যায়নে কাজটি যথাযথভাবে পরিপালিত হয়নি।
এ অবস্থায় ২০০৮ সালে মার্কিন আইন সভায় দাঁড়িয়ে আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম, সেগুলোই উচ্চারণ করতে হয় আবার-‘ন্যাটো সম্প্রসারণের কোনো দরকার নেই; এটি বরং বাতিল করা প্রয়োজন। ঝুঁকিকে কখনোই উপকারের চেয়ে বেশি বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়।’
রন পল : মার্কিন রাজনীতিক; সাবেক কংগ্রেসম্যান, ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী
(রন পল ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল)