জামায়াতের ‘নতুন কৌশলে’ প্রশাসনের যে কারণে ‘সন্দেহ’

হাসান শান্তনু

‘কোণঠাসা’ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের শুরু থেকে ‘নতুন কৌশলে’ রাজনীতির মাঠে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে জামায়াতসহ সংগঠনটির অঙ্গসংগঠনগুলো। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা ইস্যুর ‘প্রতিবাদে’ তারা ঝটিকা মিছিল করছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে মাঠ দখলে রাখার বিভিন্ন পরিকল্পনায় এগোচ্ছে সংগঠনটি।

বিশেষ করে, ‘মদপানের বিধিনিষেধ শিথিলের’ বিষয়টি কেন্দ্র করে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে সংগঠনটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্ম দিতে চায় বলে দাবি পুলিশের। সংগঠনটির পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টার পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘কিছুটা অবনতি’ ঘটছে বলে মনে করছে পুলিশ।

জামায়াতসহ এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরের দেশজুড়ে ঝটিকা মিছিল, সমাবেশের ঘটনায় তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসন আছে সতর্ক অবস্থানে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু বিভিন্ন মহানগর, জেলা, থানার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীর বর্তমান অবস্থান ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে তালিকা তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন থানায়।

যারা নাশকতার মামলায় জামিনে কারাগারের বাইরে ও পলাতক আছেন, তাদের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেজ, গ্রুপকেন্দ্রিক জামায়াত-শিবিরের নেতাদেরকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে মত ও পথকে জানায় পুলিশ প্রশাসনের সূত্র।

পুলিশের সূত্র বলছে, জামায়াতের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখতে দেশজুড়ে সাদা পোশাকের পুলিশ বাড়ানো ও থানা অনুযায়ী বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সদর দপ্তর থেকে। ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরে পুলিশের বিশেষ শাখায় আলাদা করে কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে সংগঠনটির কার্যক্রম তদারকির নির্দেশ দেওয়া আছে। অতীতে জামায়াত-শিবিরের ‘দূর্গ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এলাকাগুলোতেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার দুপুরে মত ও পথকে বলেন, পরবর্তী সংসদ নির্বাচন ও দেশব্যাপী চলমান ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় গোপনে সংগঠিত হচ্ছেন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এর প্রমাণ গত দুইমাস ধরে সংগঠনটির দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল ও সহিংসতার চেষ্টা।

যুদ্ধাপরাধের বিচার ‘ঠেকাতে’ ২০১৩ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পুনর্বহালের’ দাবিতে ২০১৫ সালে সহিংসতাপূর্ণ হরতাল-অবরোধ ডেকে রাজপথে থাকলেও গত কয়েক বছর বাহ্যত নীরব ছিল জামায়াত। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নানা ইস্যুতে হঠাৎ কিছু ঝটিকা মিছিল-জমায়েত আর গণমাধ্যমে পাঠানো বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া দলটির দৃশ্যমান তৎপরতা তেমন ছিল না।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন হারানো জামায়াতের ভেতরের খবর যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট- ‘বৈরিতার’ মধ্যেও দুইদশকের পুরোনো মিত্র বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব নিয়ে নীরবে ধৈর্যের সঙ্গে সংগঠন গুছিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে অনুকূল সময়ের অপেক্ষা করছে। বিএনপি বর্তমান ইসির অধীনে সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের পথে, ঠিক তখনই ভোটের রাজনীতিতে ফেরার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে সংগঠনটিতে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মণ্ডলের সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডের রায় আসার পর সংগঠনটি অতীতের মতো দাবি করে, ‘তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’

আব্দুল খালেকের দণ্ডাদেশ ‘বাতিলসহ’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এটিএম আজহারুল ইসলামসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সব আসামির দণ্ড ‘মওকুফের’ দাবি জানায় জামায়াত। সংগঠনটির ঢাকা মহানগরী উত্তর শাখা একই দাবিতে ‘বিক্ষোভ’ করে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। এর আগে চট্টগ্রামের নতুন চাক্তাই এলাকায় গত ১৪ মার্চ প্রায় ২০০ লোক নিয়ে মিছিল ও সমাবেশ করে মহানগর জামায়াত।

এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য, নগর সম্পাদক নুরুল আমিন। এর আগে ১০ মার্চ চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ ও থানা পুলিশের অভিযানে নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে জামায়াত-শিবিরের ২৬ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন।

রাজশাহীর বাঘায় জামায়াত ঝটিকা মিছিল করে গত ২৪ মার্চ। মিছিল থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। শতাধিক নেতাকর্মীকে নিয়ে গত ১৪ মার্চ সিলেটে ঝটিকা মিছিল কর সংগঠনটির সিলেট মহানগর শাখা। মিছিলটি প্রায় ১০ মিনিট স্থায়ী ছিল। ওইদিন দুপুরে ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে’ নগরে এ কর্মসূচি পালন করে। মিছিল শেষে সংগঠনটি সমাবেশ করে। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ‘মদপানের বিধিনিষেধ শিথিলের’ প্রতিবাদে নগরে ঝটিকা মিছিল করে সংগঠনটি।

একই ‘প্রতিবাদে’ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুর-১ এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা। দারুসসালাম এলাকায় পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুরের অভিযোগে মিছিলের পর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের আইনের সংশোধিত বিধিমালায় নিবন্ধন প্রাপ্তি সাপেক্ষে ২১ বছরের বেশি বয়সীদের মদপান ও পরিবহনের সুযোগ রাখা হচ্ছে।

কারা মদ বিক্রি করতে পারবেন, তা বিধিমালায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের মতো জামায়াতও একে ‘ইসলামবিরোধী আখ্যা’ দিয়ে ঝটিকা মিছিল, বিক্ষোভ করছে।

শেয়ার করুন